“তাহলে চলল। তুমি যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হও।”
“কপাটের ওপাশ থেকে এগিয়ে এসে যুবায়দা আবেদনের স্বরে বলল, এবারের প্রতিযোগিতায় আমিও যাবো আব্বু! আমাকে আপনি একবারও সামরিক প্রতিযোগিতা দেখাতে নিয়ে যাননি!”
একমাত্র কন্যার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না হাজ্জাজ। যুবায়দাকেও নিয়ে যেতে সম্মত হলেন।
বসরা থেকে রওয়ানা হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ ও যুবায়দাকে নিয়ে দারুল খেলাফত রাজধানীতে পৌছলেন। তিনি খলিফার সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
“আল্লাহর কসম ইবনে কাসিম! তোমার বাবার অবদানকে আমাদের পরিবার কখনো বিস্মিত হবে না।” বললেন খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিক। তিনি আমাদের খেলাফতের মর্যাদা রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন বীর বাহাদুর, তেমনি ছিলেন বিশ্বস্ত। আশা করি তুমি তোমার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলবে। ইবনে ইউসুফ! হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, আপনি কি আপনার ভাতিজাকে কারো মোকাবেলায় প্রতিযোগিতা করতে বলবেন?”
“এজন্যই তো ওকে সাথে করে এখানে নিয়ে এসেছি আমীরুল মুমেনীন! আমিও দেখতে চাই সে কতটুকু উপযুক্ত হয়েছে।”
“সে যদি তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমরা তাঁকে তাঁর পিতার পদেই বরণ করবো” বললেন খলিফা। “হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন প্রধান প্রশাসক। তার পদমর্যাদা বর্তমানের গভর্নরের চেয়ে অনেক বেশী। হাজ্জাজকে বিশেষ সম্মানে শাহী মহলেই থাকার ব্যবস্থা করলেন খলিফা। মুহাম্মদ বিন কাসিমও চাচার সাথেই শাহী মেহমান হিসাবে থাকার সুযোগ পেলো। যুবায়দাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্দর মহলে বেগমদের কাছে।
হাজ্জাজ যে মহলে অবস্থান করছিলেন, সেই মহলেই বসবাস করতো খলিফা ওয়ালিদের ছোট ভাই সুলায়মান। যুবায়দার শাহী মহলে আসার খবর শুনে সে ভীষণ খুশী হলো। সে তার একান্ত সেবিকাকে বলল, যুবায়দাকে ডেকে নিয়ে এসো। সুলায়মানের একান্ত সেবিকা এসে তাকে জানালো, যুবায়দা হাজ্জাজের ভাতিজা তার চাচাতো ভাইয়ের কক্ষে কথা বলছেন।”
“সে যেখানেই থাকুক তাকে নিয়ে এসো। তাকে গিয়ে বলো, সুলায়মান আপনাকে স্মরণ করছেন।
সেবিকা যুবায়দার কাছ থেকে ফিরে এসে জানালো, সে এখন আসতে পারবে না।”
“কোথায় সে? কি করছে?” সেবিকাকে জিজ্ঞেস করল সুলায়মান। “চীফ গভর্নরের ভাতিজার পাশে বসে হেসে হেসে কি যেন গল্প করছে।” “হাজ্জাজের ভাতিজাও কি তোমার বলার পর কোন কিছু বলেছে?”
“হ্যাঁ, সে বলেছে, পুনর্বার যেন তার কক্ষে আমি না যাই।” সুলায়মানকে জানালো সেবিকা।
একথা শুনে রাগে ক্ষোভে ফুসতে লাগলো সুলায়মান।
সেদিন বিকেলের ঘটনা। বিকেল বেলায় শাহী মহলের বাগানে পায়চারী করতে করতে যুবায়দা একটি ঘন ফুল বাগানে চলে গেল। বাহারী নানা ফুলের সমারোহে বাগানের এ অংশটিকে করে তুলেছে মোহনীয়। তাকে বাগানে পায়চারী করতে দেখে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে পিছন দিক থেকে এসে যুবায়দার দু’চোখ চেপে ধরলো সুলায়মান।
যুবায়দা হাতের ওপর হাত বুলিয়ে হেসে বলল, “হয়েছে আমি ঠিকই চিনে ফেলেছি: মুহাম্মদ ভাইয়া?”
একথা শুনে শিথিল হয়ে এলো হাত। দ্রুত সরে গেল দূরে। যুবায়দা চকিতে পিছন ফিরে তাকালো।
বলল, “ওহ! সুলায়মান! আমি আশা করেছিলাম তুমি নিশ্চয়ই আসবে!”
“না, তুমি তো আশা করেছিলে বিন কাসিম আসবে! কিছুটা ক্রোধমাখা স্বরে বলল সুলায়মান। এই জন্যই তো তোমার মুখ থেকে ওর নামই বেরিয়েছে।
“হু, ওর নাম নেয়া কি অপরাধ?” “তা জানি না, তবে কারো সাথে প্রতারণা করা নিশ্চয়ই অপরাধ! আমাকে ধোকায় ফেলে রেখো না যুবায়দা! বিন কাসিম ও আমার ব্যাপারে তোমার অবশ্যই চূড়ান্ত ফায়সালা করা উচিত। ফায়সালা ভেবে চিন্তে করা উচিত। কারণ আমি আগামী দিনের খলিফা আর বিন কাসিম হবে আমার অধীনস্ত একজন কর্মচারী মাত্র। আমি ইচ্ছা করলে তাকে সেনাপতি থেকে সিপাই বানাতে পারব, ইচ্ছা করলে ভিখারীতে পরিণত করতে পারব।…আচ্ছা…তুমি ওর মধ্যে এমন কি দেখেছ, যা আমার মধ্যে দেখতে পাওনি?”
“ওর ভালোবাসায় কোন খাদ নেই” বলল যুবায়দা আমি ওকে সেনাপতি অবস্থায় যেমন ভালোবাসবো, সিপাহী হলেও তেমনি ভালোবাসবো। তাতে আমার ভালোবাসায় কোন ভাটা পড়বে না। তুমি যদি তাকে ভিখারীতে পরিণত করো, তবুও কারো কাছে ওকে হাত পাততে দেবো না। আমার ভালোবাসা পদমর্যাদা ও ক্ষমতার গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।” যুবায়দা নাগাল থেকে চলে আসার জন্যে এগুতে শুরু করলেসুলায়মান আগ বেড়ে ওকে ধরে ফেলল এবং যুবায়দার কাছে প্রেম ভিক্ষা করতে শুরু করল। শৈশবের স্মৃতি মন্থন করে অতীতের ভালো লাগা, এক সাথে খেলাধুলার কথা স্মরণ করাতে লাগল। যুবায়দা তার কাছ থেকে বারবার চলে আসতে চাচ্ছে আর ফিরে ফিরে সুলায়মান তার হাত ধরে আটকে রাখতে চাচ্ছে।
“সুলায়মান! ভরাট কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো দূর থেকে।”
চকিতে সুলায়মান ও যুবায়দা তাকিয়ে দেখতে পেল ফুল গাছের আড়ালে হাজ্জাজ দাড়ানো।
“ভালো হয়েছে যে আমি নিজের চোখে দেখতে পেলাম। আরো ভালো হয়েছে, তুমি কি বলেছো, আর আমার মেয়ে কি বলেছে, তা আমি নিজের কানে শুনেছি।” প্রিয় সুলায়মান। তোমার ধৃষ্টতাকে আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ মনে করছি না। কারণ যৌবন আসলে একটা পাগলামী। কিন্তু তোমাকে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। এ ব্যাপারে কি করবো, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেবো, আমার মেয়ের কোন সিদ্ধান্ত এতে থাকবে না। তুমি জানো, তোমার সমবয়স্ক আমার একটি ভাতিজা আছে। ও আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে…। আমার মেয়ে তারই বউ হবে।” মাথা নীচু করে অােবদনে দাড়িয়ে ছিল যুবায়দা। হাজ্জাজ যুবায়দার হাত ধরে সাথে নিয়ে বাগান থেকে চলে গেলেন। সুলায়মান ঠায় দাঁড়িয়ে পিতা-কন্যার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চেহারা তখন ক্ষোভে অপমানে বিবর্ণ হয়ে উঠল, মাথায় যেন শুরু হলো অগ্ন্যুৎপাত। টগবগিয়ে ফুটতে থাকল শরীরে রক্তকণিকা। সে ভেবে পাচ্ছিল না হাজ্জাজ ও মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কাবু করে কিভাবে যুবায়দাকে কব্জা করবে।”