“শোন যুবায়দা! তোমার এখানে আসা অবশ্যই আমার কাছে ভালো লাগেনি। তবে এর সাথে তোমাকে খারাপ লাগার কোন সম্পর্ক নেই। আমি তোমার চোখ ও তোমার মুচকি হাসি দেখেই তোমার ভিতরের অবস্থা বুঝতে পেরেছি। আমার মধ্যেও যে এমনটি নেই তা বলব না। কেঁপের ভিতরে বসা থেকে উঠে বেরিয়ে আসতে আসতে মুহাম্মদ বলল, এসো, আমরা মহলের দিকে এগুতে থাকি। যাতে কেউ দেখলেও এটা ভাবতে না পারে যে, আমরা নিরিবিলি বসে ছিলাম।”
“মুহাম্মদ ভাইয়া! তুমি এখন কি করবে?” পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল যুবায়দা।
“আমি আমার ইচ্ছা ও স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। যেসব প্রশিক্ষণ আমি নিয়েছি এসব কলা-কৌশল আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।”
“তুমি কি সেনাপতি হতে চাও?”
“আমি কোন পদ পদবীর প্রত্যাশা করি না। আমার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, চোখের সামনে একটাই পথ, আমি ওই পথ ধরে চলতে চাই, যে পথ জীবন ও রক্তের বিনিময়ে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তৈরী করে গেছেন। একটি পথ তৈরী হয়ে গেছে সে পথে হাজার কোটি মানুষ চলতে পারে। আর যারাই সে পথ অতিক্রম করে তারা কিছু না কিছু পদচিহ্ন তো রেখেই যায়। সে পথে গমনাগমনকারীরা পূর্ববর্তীদের পদচিহ্ন মুছে দিয়ে নতুন পদচিহ্ন তৈরী করে কিন্তু এমন কিছু চিহ্ন থাকে, যেগুলো কখনও মুছে ফেলা যায় না। পথভোলা পথিকরা সেই অক্ষুন্ন পদচিহ্ন দেখে দেখে তাদের মনযিলে পৌছাতে পারে। আমিও সেইসব বীরপুরুষদের অমুছনীয় পদচিহ্ন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।”
“কারা সেইসব কৃতীপুরুষ?” জিজ্ঞেস করল যুবায়দা। “খালিদ বিন ওয়ালিদ আমার সেই স্বপ্নপুরুষ।” জবাব দিলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। বিন ওয়াক্কাস, আবু বকর, ওমরও আমার অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমি
এসব মহাপুরুষদের মিশনকে আরো এগিয়ে নিতে চাই। আমি মুসলিম শাসনের সীমানা আরো দূর দারাজ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাই। আমি শুধু শুধু সেনাপতির তকমা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে চাই না, আমি চাই আল্লাহর সৈনিক হয়ে জীবন কাটাতে।”
মুহাম্মদের কথা শুনতে শুনতে তার দৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী সংকল্প এবং পৌরুষদীপ্ত মন-মানসিকতার প্রভাবে নিজেকে স্বপ্নময় পুরুষের বিশালতায় হারিয়ে দিলো যুবায়দা। মুহাম্মদ বিন কাসিম এভাবে কথা বলছিল, মনে হয় যেন তার কথাগুলো কোন তরুণের স্বপ্ন নয় অতি বাস্তব। সে কোন কল্পনা বিলাসে নিজেকে আপুত করছে না, ইচ্ছা ও সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মতো দৃঢ়চিত্ত ও প্রত্যয়ী সে। “যুবায়দা! আমি আমার মায়ের দেখা স্বপ্নের বাস্তব প্রতীক। কিন্তু সেই স্বপ্নের এখনো বাস্তবতা পায়নি। আমাকে অবশ্যই সেই তারকা হতে হবে যে তারকার স্বপ্ন আম্মু দেখেছিলেন।”
দু’জন কথা বলতে বলতে মহলের প্রবেশ পথে এসে গেলে মুহাম্মদ নীরব হয়ে গেল এবং যুবায়দার উদ্দেশে বলল, “যুবায়দা! এখন তুমি তোমার পথে যাও। আমি একাকী মহলে প্রবেশ করবো।”
মুহাম্মদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল যুবায়দা। তার চোখে চোখ রেখে বলল, “মুহাম্মদ ভাইয়া! জানি না, হয়তো সেই শৈশব থেকে তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি। আবেগাপ্লুত ধরা গলায় বলল যুবায়দা। বলল, আমার মন চাচ্ছে তোমার সফরসঙ্গী হতে…। তুমি কি আমাকে সঙ্গে নেবে?”
“আল্লাহর যদি মর্জি থাকে তাতে আমার আপত্তি নেই।” একথা বলেই দ্রুত পায়ে মহলের পথে পা বাড়ালো মুহাম্মদ।
বসন্তকাল। এ সময়ে দারুল খেলাফত তথা রাজধানীতে সেনাবাহিনীর বাৎসরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কুশলী যোদ্ধারা নানা ধরনের নৈপুণ্য, শৈল্পিক ও নান্দনিক যুদ্ধ কৌশল প্রদর্শন করে। সামরিক ও বেসামরিক লোকজন এ কুচকাওয়াজ দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। অগণিত দর্শকের সমারোহে মুখরিত হয় ময়দান। খলিফা নিজে উপস্থিত থেকে কৃতী কুশলীবদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন। খেলাধুলার মধ্যে ঘোড়দৌড়, বর্শা, তরবারী, তীর ও মল্লযুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। খলিফা আব্দুল
মালিক বিন মারওয়ানের সময় প্রশাসন নানা বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকার কারণে বসন্তকালীন মহড়া অনুষ্ঠানের সুযোগ তেমন হয়নি। তিনি কঠোরভাবে সব ধরনের গোযোগ দমন করায় তার ছেলে ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের সময় কোন গোলযোগ ছিল না। এজন্য খলিফা প্রতি বছরের বসন্তে রাজধানীতে বিশাল আকারে সামরিক মহড়ার আয়োজন করতেন। এ উৎসবে এতো কঠিন প্রতিযোগিতা হতো যে, সামরিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগীর হাতে যদি কেউ মারাও যেত তবুও এতে কোন শাস্তি হতো না।
একদিন খলিফার বিশেষ দূত বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পয়গাম নিয়ে গেল, বাৎসরিক সামরিক উৎসবে যোগদান করার জন্যে তিনি যেন এক্ষুণি খলিফার সাথে দেখা করেন। তা ছাড়াও তার সাথে খলিফার জরুরী পরামর্শ রয়েছে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার পয়গামে খুশী হলেন। খুশীর প্রধান কারণ তিনি ভাতিজা মুহাম্মদকে খলিফার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। খলিফার পয়গাম এ কাজটির জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে আনলো। বাৎসরিক সামরিক উৎসবটি তার জন্যে আরো সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি সামরিক প্রতিযোগিতায় মুহাম্মদকে অংশগ্রহণ করিয়ে খলিফা ও সেনাপতিদের এ বিষয়টি দেখিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন, এতটুকু বয়সে তার ভাতিজা সমরবিদ্যায় কি পরিমাণ যোগ্যতা অর্জন করেছে। তিনি চাচ্ছিলেন পরিচয়ের শুরুতেই সবার চোখে মুহাম্মদকে তাঁর কৃতিত্বের মাধ্যমে একটা সম্মানজনক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি তখনই মুহাম্মদকে ডেকে বললেন, “মুহাম্মদ! তুমি তরবারী চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড়, ও মল্লযুদ্ধে কতটুকু পারদর্শী আমি জানি না। বসন্ত উৎসব একটা সুযোগ। আমি এ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে তোমাকে সামরিক প্রতিযোগিতায় সম্পৃক্ত করতে চাই। আশা করি তুমি আমাকে লজ্জিত করবে না।” “হার জিত আল্লাহর হাতে চাচাজান! আমি বড়াই করতে চাই না। তবে প্রতিযোগিতায় অবশ্যই অবতীর্ণ হবো।”