“আমাদের রীতি তো এটাই যে, আমরা যদি কাউকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করে ফেলি। আর যে খলিফা হয় সে একাধিক বউ রাখে।”
“আমি এই রীতিনীতির কথা বলছি না” বলল যুবায়দা। আমি মুসলমানদের সামরিক রীতিনীতির কথা বলছি। যারা রোম পারস্যের শক্তিশালী সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো করে ইসলামের সীমানা কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা দেখো। মুসলমানরা পরস্পর বিরোধ বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। কোন জায়গায় দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ, কোথাও অসন্তোষ, কোথাও ষড়যন্ত্র। এর ফলে পরাজিত রোমানদের তরবারী আমাদের মাথার ওপরে ঝুলছে। তুমি কি একথা জানো না, রোমানদের সাথে আমাদের যে শান্তিচুক্তি করতে হয়েছে, তাতে কি পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে। খুবই মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমাদের শান্তি খরিদ করতে হয়েছে। টাকার বিনিময়ে শান্তি চুক্তি করে আমরা একথাই প্রমাণ করেছি যে, দ্বীন ও মিল্লাতের
হেফাযত ও দেশের সীমানা রক্ষার ক্ষমতা এখন আর আমাদের নেই। আমরা খুবই দুর্বল অক্ষম হয়ে গেছি।”
সুলায়মান যুবায়দার এসব কথায় অস্থির হয়ে বলল, আহা চাঁদ! তুমি এমন মনোরম রাত আর আবেগকে গলাটিপে মেরে ফেলছো। হায়! এমন চাঁদনী রাতে চাঁদের চেয়েও সুন্দর রাতটি আর আমার ভালোবাসার স্বপ্নগুলোকে নিরস, বিষাদময় কথাবার্তার বিবর্ণ চাদরে ঢেকে দিচ্ছো। তুমি কি বলতে চাচ্ছো, যেসব কথা তুমি আমাকে শোনাচ্ছ, এসব আমি মোটও জানি না? তোমার কি একথা জানা নেই যে, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর খেলাফতের মসনদে আমাকেই বসতে হবে?”
“আমি চলে যাচ্ছি…বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল যুবায়দা। আমাকে এখন চলে যেতে হবে। মা যদি টের পেয়ে যায়…।”
“তিনি তো তার ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। বলল সুলায়মান। কি হয়ে গেল তোমার? সুলায়মানও বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল। এর আগে তুমি কখনও এমনটি করনি।”
যুবায়দা দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো। সুলায়মানও ওর পিছু পিছু রওয়ানা হলো।
“কি ব্যাপার! তুমি কি আমার ভালোবাসাকে ভেঙেচুরে চলে যাচ্ছ?”
“না সুলায়মান! দাঁড়িয়ে বলল যুবায়দা। আমি তোমার ভালোবাসাকে অপমান করছি না। আমি বিয়ের কথা বলছি, আমাকে ভাবতে দাও সুলায়মান! আমাকে ভাবতে দাও। কথা বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো যুবায়দা।
কয়েক দিন পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তায়েফ থেকে বসরায় ফিরে আসলেন। তার বাহন মহলে প্রবেশ করতেই যুবায়দা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘোড়ার গাড়ি থেকে হাজ্জাজ নেমে এলেই পিতাকে জড়িয়ে ধরলো যুবায়দা। পিতাও পরম আদরে আদুরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যুবায়দার চেহারা ছিল ঘোড়ার গাড়ির দিকে। সে দেখলো, গাড়ি থেকে দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের এক অচেনা কিশোর বেরিয়ে এলো। পৌরুষদীপ্ত, আকর্ষণীয় কিশোরের চেহারা।
যুবায়দা একেবারে লেপ্টে ছিল পিতার বুকের সাথে। অচেনা কিশোরের দিকে নজর পড়তেই তার বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। কিশোরের প্রতি আটকে গেল তার দৃষ্টি।
“সামনে এসো মুহাম্মদ!” নাম ধরে কিশোরকে আহবান করলেন হাজ্জাজ। যুবায়দাকে দেখিয়ে বললেন, “এ আমার মেয়ে যুবায়দা। যুবায়দা! এ তোমার চাচাতো ভাই মুহাম্মদ। তুমি একে আর দেখনি। এই আমার ভাইয়ের একমাত্র সন্তান। সে আমাদের সাথে কিছুদিন থাকবে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম, চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মহলে দিন কাটাতে লাগলো। যুবায়দা খুব গভীরভাবে মুহাম্মদের চলাফেরা দেখতো, মাঝেমধ্যে টুকিটাকি কথাও বলতো। চাচাতো ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বললেও যুবায়দা স্বভাবজাত লজ্জা ও পর্দা কখনো লঙ্ঘন করেনি।
এক বিকেলে মহলের বাগানে পায়চারী করছিল মুহাম্মদ। বাগানের একটি জায়গা খুবই ভালো লাগল তার কাছে। পাশাপাশি দুটি ঘন গাছের ঘন ডালপালায় ঝোপের মতো হয়ে উঠেছে। গাছ দুটি ছিল ফুলধারী। বসন্তের মৌসুম থাকায় ঘন ঝোপ সদৃশ্য গাছের ডালপালাগুলো ফুলে ফুলে অপরূপ সাজে সজ্জিত, ফুলের সমারোহে ছাউনীর মতো গাছের ঝোপের নীচে মুগ্ধ মনে বসে পড়লো মুহাম্মদ। দৃশ্যটি তাঁর মন কেড়ে নিলো।
দূর থেকে যুবায়দা মুহাম্মদ এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। ফুলের ঝোপের মধ্যে বসতে দেখে যুবায়দাও পায়চারী করতে করতে মুহাম্মদের কাছে চলে এলো। যুবায়দা কাছে এসে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবতা ভেঙে বলল, এখানে একাকী বসে কি ভাবছো মুহাম্মদ ভাইয়া!
“ফুলে ফুলে সাজানো জায়গাটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। এজন্য একটু বসলাম।”
“আমিও কি তোমার পাশে বসবো?” “চমকে উঠলো মুহাম্মদ। বলল, না না!” “কেন?”
“এটা ভালো দেখাবে না। কেউ দেখলে কিংবা চাচার চোখে পড়লে ব্যাপারটি ভালো দেখাবে না। আমি ভাই একাকী তোমার পাশে বসে থাকতে পারবো না।”
“চুপি চুপি আমিও তোমার সাথে বসতে চাই না মুহাম্মদ ভাইয়া!” কথাটি বলেই চিন্তায় হারিয়ে গেল যুবায়দা। “পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো যুবায়দা! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় কোন যুবক যুবতী নিরিবিলি জায়গায় পাশপাশি অবস্থান করা
মোটেও ঠিক নয়…। তুমিও কি আমার মতো হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসেছো, নাকি আমাকে দেখে ইচ্ছা করেই এসেছো?”
“তোমাকে তো আমি প্রতিদিনই দেখি। একাকী হাঁটতে ভয় ভয় লাগছিল এজন্য…। আচ্ছা, মুহাম্মদ ভাইয়া! একটি কথা জিজ্ঞেস করছি। আমার এখানে আসায় তুমি কি বিরক্ত হয়েছ? তোমার কাছে কি আমার আসাটা খুবই বিরক্তি সৃষ্টি করেছে? আমাকে কি তোমার কাছে খারাপ লাগে?”