কৌতূহলী দর্শকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঠাট্টা করলেও মুসলমানরা ছিল চুপচাপ। তারা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে তাদের সবার হাত ছিল তরবারির বাটের উপর।
আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন এরপর হঠাৎ কি হল! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন পাল্টা আক্রমণ করলেন যে, মুহুর্তেই লড়াইয়ের মোড় ঘুরে গেল। জনতার উচ্চকিত আওয়াজ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে জনগণ দেখল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অপূর্ব রণকৌশল আর শক্তির বিশালতা। ইবনুল আছীর লিখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকানাকে দু’হাতে উঁচু করে ধরে জোড়ে আছার মারেন। এতে রুকানা আহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গর্জে উঠে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আক্রমণে তেড়ে আসে। তিনি এবারও অপূর্ব কৌশলে হামলা করেন এবং তাকে ধরে আবার মাটিতে ছুড়ে মারেন। সে পুনরায় আক্রমণ করতে উঠে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় বারের মত আবার তাকে উপরে তুলে আছাড় মারেন। বিশাল শরীরে পরপর তিনবার প্রচণ্ড আঘাত খাওয়ায় রুকানা কুস্তি লড়তে অযোগ্য হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে কুস্তি মঞ্চ থেকে নেমে আসে।
উপস্থিত জনতার উপর পিন-পতন নীরবতা নেমে আসে। সব মুখগুলো হঠাৎই নিরব হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতা এবং ফলাফল বিপর্যয়ে কুরাইশদের মাথা নীচু হয়ে চুপসে যায়। অপরদিকে হাতে গোনা মুসলমানরা আনন্দে নাঙ্গা তলোয়ার এবং বর্শা উর্ধ্বদিকে উঁচিয়ে মুহুর্মূহু গগনবিদারী আওয়াজ দিতে থাকে।
“চাচা রুকানা!” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চঃস্বরে ডেকে বলেন “আপনার অঙ্গীকার পূরণ করুন এবং এখনই ঘোষণা করুন যে, আজ থেকে আপনি মুসলমান।”
কিন্তু রুকানা ইসলাম গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
♣♣♣
“এটা কেবল দৈহিক শক্তি বলে সম্ভব হয়নি।” খালিদ খেজুর বাগানে শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলছিলেন – “রুকানাকে এভাবে তিন তিনবার আছাড় মারা তো দূরের কথা, তাকে কেউ আজোবধি চিৎ করতে পারেনি।”
এ মুহূর্তে খালিদের চোখের সম্মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা মোবারক কমনীয় হয়ে ভেসে ওঠে। শৈশবকাল থেকেই তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভাল ভাবেই চিনতেন-জানতেন। কিন্তু কালক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের মোড় অন্যদিকে ফিরে যায়। নবুওয়াত লাভের পর তাঁর জীবন যেরূপে আলোকিত হতে থাকে খালিদ সে রূপের সাথে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। মক্কায় তিনি নবুওয়াতের দাবি করার পর খালিদ তাঁর সাথে কথা বলাই ছেড়ে দেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উত্তম শিক্ষা দিতে চান, কিন্তু রুকানার মত কুস্তিগীর নন তিনি হচ্ছেন রণাঙ্গনের লড়াকু বীর যোদ্ধা। এবং যুদ্ধ পরিচালনা করায় তখনকার সময় তাঁর জুড়ি ছিল না। কিন্তু তখন মুসলমানদের লড়াই করার পরিস্থিতি ছিল না।
মুসলমানরা যখন রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হওয়ার উপযোগী হলো তখন কুরাইশদের সাথে তাদের প্রথম ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন খালিদ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যে, ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হল না। এ জন্য তার দুঃখ ছিল সীমাহীন। এ যুদ্ধে ৩১৩ জন মুসলিম বীর মুজাহিদ ১০০০ কুরাইশকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। সেদিন খালিদ এ বেদনাদায়ক সংবাদ দাঁত কামড়ে সহ্য করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি এক খর্জুর বাগানে শায়িত। তার এখনো ভাবতে অবাক লাগে যে, নিরস্ত্রপ্রায় হাতে গোনা কয়েকজন লোক কিভাবে সশস্ত্র এক দুর্ধর্ষ বিশাল বাহিনীকে এভাবে পরাভূত করে? তাইতো সেদিন তিনি পরাজিত কুরাইশ যোদ্ধাদের নিকট জানতে চান যে, তাদের মধ্যে এমন কোন বিশেষত্ব রয়েছে, যার ফলে তারা এমন অসম যুদ্ধেও বিজয়ের তাজ কেড়ে নিতে সক্ষম হল?
খালিদ এ সমস্ত কথা আওড়াতে আওড়াতে হঠাৎ উঠে বসেন এবং আঙ্গুলের সাহায্যে বালুকাময় ভূমিতে বদর রণাঙ্গনের ছক এঁকে কুরাইশ ও মুসলমানদের অবস্থান এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় গৃহীত বিভিন্ন কৌশল পরীক্ষা করেন। তার বাবাই তাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করেছিল। বেয়াড়া এবং দুষ্ট ঘোড়া বাগে আনার প্রশিক্ষণও তাকে দিয়েছিল। ফলে যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন বিখ্যাত অশ্বারোহী হয়ে উঠেন। উষ্ট্রারোহী হিসেবেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। সে খালিদ কে কেবল সৈনিকই নয়, যোগ্য সিপাহসালার হিসেবে গড়ে তুলেছিল। ফলে হযরত খালিদ এমন যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, সমর বিষয়ক বিভিন্ন কলা-কৌশল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। যুদ্ধবিদ্যায় আশাতীত সাফল্য হেতু যুবক বয়সেই তিনি সৈন্য পরিচালনায় সর্বোচ্চ যোগ্যতা হাসিল করতে সক্ষম হন।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার দুঃখ ছিল খালিদের। এ যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয় তাকে এমন বেদনাহত করে যে, তিনি এর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের দৃঢ় শপথ করেন। কিন্তু তার বর্তমান চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন ধারায় পরিচালিত। মক্কা হতে যাত্রার ক’দিন আগে তিনি দু’টি বিষয়ে গভীর চিন্তা করেন। এক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিখ্যাত কুস্তিগীর রুকানাকে উপর্যুপরি তিনবার কপোকাত করা। দুই. বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন দ্বারা হাজার সৈন্যের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদুস্ত করা। তিনি কিছুতেই একে দৈহিক শক্তির ফল বলে মানতে পারছিলেন না। তার সব সময় মনে হয়েছে, এটা অদৃশ্য শক্তিরই ফল। যার কাছে তারা বারবার পরাজিত হচ্ছে। অকেজো হয়ে যাচ্ছে তাদের হাতিয়ারগুলো। অসহায় হয়ে পড়ছে আরবের বিখ্যাত বীর-যোদ্ধারা, তারপরও বদর যুদ্ধের প্রতিশোধের আগুন তার মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলছিল।