নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল কুরাইশদের চার নেতা।
১) খালিদের পিতা ওলীদ (২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আপন চাচা আবু লাহাব। (৩) আবু সুফিয়ান ও (৪) খালিদের চাচাত ভাই আবুল হাকাম তথা আবু জেহেল। মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার নিপীড়নের কুখ্যাত রেকর্ডটি এই পাপীষ্ঠেরই দখলে ছিল। ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম নিধনে তার পাষণ্ডতা সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে মুসলমানরা তার নাম রাখে আবু জেহেল। এ নামটি এত প্রসার লাভ করে যে মানুষের হৃদয় থেকে তার আসল নামটি মুছে যায়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই উঁচু-লম্বা, মোটা-তাজা এবং লৌহমানব লোকটি ইতিহাসে ‘আবু জেহেল’ নামেই কুখ্যাত।
♣♣♣
অতীতের এ স্মৃতিগুলো তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। হয়তোবা ভিতরে ভিতরে খালিদ অনুশোচনায় দগ্ধও হচ্ছিলেন। কুরাইশরা কয়েকবার রাসূলের গৃহে অপবিত্র মল-মূত্র ছুঁড়ে মারে। যেখানেই কোন মুসলমান দাওয়াতী কাজ করত, সেখানেই কুরাইশরা উপস্থিত হয়ে হৈ-হুল্লুড় শুরু করে দিত। বেয়াদবি ও হট্টগোল করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ও কষ্ট দিত।
খালিদ এ ব্যাপারে পূর্ণ আশাবাদী ছিলেন যে, তার পিতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এ ধরনের কোন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেন নি। সর্বোচ্চ ভূমিকা তার এই ছিল যে, সে দু’বার কুরাইশদের তিন-চার নেতাকে নিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালেবের কাছে গিয়ে তাকে এই মর্মে সাবধান করে যে, তিনি যেন আপন ভাতিজাকে প্রতিমার সমালোচনা এবং ইসলামের দাওয়াত থেকে বারণ করেন। নতুবা সে কারো হাতে মারা যেতে পারে। আবু তালেব দু’বারই তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। তাদের দাবী আমলে নেননি।
খালিদের স্মরণ হয়ে যায় তার পিতার ত্যাগ ও কুরবানীর কথা। আম্মারা নামে তার এক সুদর্শন টগবগে যুবক ভাই ছিল। সে ছিল যেমনি মেধাবী তেমনি সৌখিন। ওলীদ তার এই সোনার ছেলে আম্মারাকে দুই কুরাইশ নেতার হাতে সমর্পণ করে বলল, একে মুহাম্মাদ এর চাচা আবু তালিবের নিকট নিয়ে গিয়ে বল, ওলীদের পুত্রটি দিয়ে গেলাম, তার পরিবর্তে মুহাম্মাদকে আমাদের যিম্মায় ছেড়ে দিন।
সেদিন খালিদ তাঁর পিতার সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যান এবং যখন তাঁর ভাই আম্মারা দুই কুরাইশ নেতার সঙ্গে চলে যায় তখন তিনি নির্জনে গিয়ে খুব ক্রন্দন করেছিলেন।
‘আবু তালেব’ দুই নেতা আম্মারাকে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচা আবু তালিবের সম্মুখে উপস্থিত করে বলে এই যুবককে নিশ্চয় তুমি চেন। এ আম্মারা বিন ওলীদ। তুমি এও জান যে, তোমার নেতৃতাধীন হাশেম বংশে এর ন্যায় জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ছেলে একটিও নেই। একে সাড়া জীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দিতে এসেছি। পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলে সে আজীবন তোমার বাধ্য হয়ে থাকবে। আর গোলাম হিসেবে গ্রহণ করলেও সে তোমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হবে না।
কিন্তু আগে বল তোমরা তাকে কেন আমার হাতে তুলে দিচ্ছ?” আবু তালেব উৎসুক হয়ে জানতে চান –“মাখযুম গোত্রের মায়েরা কি সন্তান নিলাম দেয়া শুরু করেছে… বলো, এর বদলে কত দাম চাও?”
তার বদলে তোমার ভাতিজাকে দিয়ে দাও” এক নেতা বলে উঠে। “নিঃসন্দেহে তোমার ভাতিজা কলঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে নতুন ধর্মের প্রচার শুরু করেছে। দেখছো না, সে গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে পরস্পরকে দুশমনে পরিণত করেছে?”
“ভাতিজাকে নিয়ে তোমরা কি করবে?” জানতে চাইলেন আবু তালিব।
দ্বিতীয় নেতা জবাব দিল– “আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করব। এটা অবিচার কিংবা কোনরূপ অন্যায় হবে না। কেননা ভাতিজার বদলে আমরা তোমাকে নিজেদের সন্তান দিচ্ছি।”
“এটা খুবই অসঙ্গত প্রস্তাব আবু তালিব বলেন। “তোমরা আমার ভাতিজাকে নিয়ে কতল করবে আর আমি তোমাদের সন্তান লালন-পালন করব, অর্থাৎ তার পিছনে খরচ করব এবং তার সুন্দর জীবন গড়ে দিব। তোমরা আমার কাছে এ কেমন অযৌক্তিক প্রস্তাব নিয়ে এসেছো?… সম্মানের সাথে আমি তোমাদের বিদায় দিচ্ছি।”
খালিদ দুই নেতার সাথে ভাইকে ফিরে আসতে দেখে এবং এ বিনিময় প্রস্তাব গ্রাহ্য না হওয়ায় তিনি সেদিন মনে মনে বড় খুশি হয়েছিলেন।
♣♣♣
“মুহাম্মাদকে তুমি কি মনে করেছ – আবু সুলাইমান।” খালিদের ভিতর থেকে একটি প্রশ্ন উদয় হয়। তিনি চিন্তার রাজ্যে থেকেই মাথা নাড়ান এবং মনে মনে বলেন– কিছু নয়.. এটা ধ্রুব সত্য যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরীরে প্রচুর শক্তি আছে। কিন্তু তাই বলে রুকানা বিন আব্দে ইয়াযিদের ন্যায় বাহাদুরকে উচু করে আছাড় দেয়ার জন্য দৈহিক শক্তিই কখনো যথেষ্ট নয়।
রুকানা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচার নাম। সে তখনো অমুসলিম। বাহাদুর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল সমগ্র আরব জুড়ে। বিভিন্ন সময় বহু বীর-বাহাদুর তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু কেউ তার সামনে এসে টিকতে পারেনি। প্রত্যেককে দুগ্ধপোষ্য শিশুর ন্যায় পাঁজাকোলা করে এমন আছাড় মারে যে, তারা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। লড়াই-মারামারিই ছিল তার পেশা।