গুপ্ত হত্যাকারীরা যে রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাসভবনে হানা দেয় সে রাতে তিনি সেখানে ছিলেন না। ছিল না ঘরের আসবাবপত্র কিছুই। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ঘাতকদের পাঠিয়ে এ আশায় গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় যে, আগামীকাল ভোরের প্রথম শিরোনাম হবে ‘মূর্তিপূজার সমালোচক ও নতুন ধর্মমতের প্রবর্তক নিহত’। কিন্তু পরের ভোর তাদের জন্য কোন সুসংবাদ বয়ে আনল না। তিক্ত হলেও এক মহা দুঃসংবাদ তাদের হজম করতে হলো। হতাশা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মক্কায়, চরমভাবে ব্যর্থ হয় তাদের ভয়ানক ষড়যন্ত্র। পেছনের মানুষ তাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করে এই ভয়-ভীতিতে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। পরস্পর সাক্ষাতে শুধু এতটুকুই কানাকানি করে যে– “মুহাম্মাদ গেল কই? এদিকে হত্যার সুনির্দিষ্ট ক্ষণের অনেক আগেই ওহী মারফৎ ‘হত্যা-ষড়যন্ত্র’ অবগত হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভোর পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সাত বছর পর খালিদ মদীনায় যাচ্ছেন। তাঁর স্মৃতিজুড়ে এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থান। অথচ উহুদ যুদ্ধে তিনি হুবল ও উযযা দেবীর প্রধান দুশমন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে হত্যার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাগপাশ এড়াতে সক্ষম হন। ফলে তাঁর সকল চেষ্টা অরণ্যে রোদন হয়।
খালিদের স্মৃতির সব ক’টি পর্দা ছিল বিগত ঘটনায় ভরপুর। স্মৃতির কুঠোরে সবই ছিল সংরক্ষিত। একটু অবসর পেয়ে এসব অতীত স্মৃতি এক এক করে তার সম্মুখে বর্তমান হয়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে স্মৃতি তাকে নিয়ে দাঁড় করায় ১৬ বছর পূর্বের একটি ঘটনা ও দৃশ্যের মুখোমুখি। তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে ৬১৩ খিষ্টাব্দের এক দুপুর বেলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে তাঁর বাসভবনে এক ভূড়িভোজের দাওয়াত দেন। আহার পর্ব সমাপ্তির পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগত মেহমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন–
‘বনু আব্দুল মুত্তালিবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। আমি আপনাদের সম্মুখে ইসলামের দাওয়াত পেশ করে চলেছি, সমগ্র আরবের আর কেউ তা পেশ করতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা এর জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন। তিনি আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি আপনাদেরকে যেন এমন এক ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি আহবান জানাই, যা আপনাদের ইহকালের সাথে সাথে পরকালের জীবনকেও সুখময় ও সাফল্যমণ্ডিত করবে।”
ওহী নাযিলের ৩ বছর পর এটা ছিল নিকটবর্তী আত্মীয়দের প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সর্বপ্রথম আহ্বান। খালিদ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তার পিতা ছিল আমন্ত্রিত মেহমান। পিতাই তাকে তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিল যে, “আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র মুহাম্মাদ দাবী করছে, সে নাকি আল্লাহর প্রেরিত নবী।”
আমরা স্বীকার করি যে, আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন কুরাইশদের একজন প্রভাবশালী নেতা।” “নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ কুলীন বংশের সন্তান। কিন্তু তাই বলে নবুওয়াতের দাবী এই বংশের লোক করবে কেন? হুবল ও উযার কসম। আমার বংশের মান মর্যাদা কারো থেকে কম নয়। নবুওয়াতের দাবী করে কেউ আমাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে-এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।”
“আপনি তাকে কি বললেন?” খালিদ জিজ্ঞেস করলেন।
“আমরা প্রথমে নীরব থাকলেও পরে সকলেই তার দাবী হেসে উড়িয়ে দিই। মুহাম্মাদের চাচাত ভাই আলী বিন আবু তালেব মুহাম্মাদের নবুওয়াতের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁর পিতার সে বিদ্রুপাত্মক হাসি খালিদের আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের অন্য আরেক ঘটনা খালিদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। সেদিনও তিনি মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী খর্জুর বাগানে শায়িত ছিলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াত ও রিসালাত নেতারা মেনে না নিলেও অন্যান্যরা ঠিকই স্বীকৃতি দিচ্ছিল। এদের অধিকাংশই যুবক শ্রেণীর। অনেক নিঃস্ব-গরীব লোকও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এতে করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শক্তি সাহস বেড়ে গেল।
ইসলামের পূর্বযুগে আরব জাতি এক আল্লাহকে মেনে নিলেও অগণিত মূর্তির পূজাও করত। পুরুষরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেব’ আর নারীরূপী মূর্তিগুলোকে ‘দেবী’ হিসেবে মানা হত এবং তাদেরকে আল্লাহ্র পুত্র-কন্যা মনে করা হত।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচারিত ইসলামের ক্রমোন্নতি দেখে কুরাইশরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বেঁচে থাকার অধিকার নস্যাৎ করার প্রস্তুতি নেয়। হযরত খালিদের এ কথাও মনে পড়ে যে, তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মক্কার অলি-গলি এবং হাটে-বাজারে মানুষ সমবেত করে ইসলামের দাওয়াত দিতে এবং এ কথা বলতে শুনেছেন যে, প্রতিমা তাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। কাউকে তিনি তাঁর ইবাদতের মাধ্যমও বানাননি।