একদিন আযাদাবাহ শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। সে শহরের হাজার হাজার সৈন্য সমবেত করেছিল। সে ঘুরতে ঘুরতে যে দলের সামনে যেত তাদেরকে জোরে জোরে বলত “যরথুস্ত্রের কৃপা হোক তোমাদের প্রতি! যারা কাজিমা, মাজার এবং উলাইয়িসে মরু বুদ্দুদের হাতে পরাস্ত হয়েছে তারা কাপুরুষ ছিল। তাদের মৃত দেহ যরথুস্ত্রের অগ্নিশিখা চাটছে।… হে ঈসা-মসীহের অনুসারীরা। তোমারা আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে এসেছ। স্মরণ কর, তোমাদের ঐ কন্যাদের কথা যারা বাঁদী হয়ে মদীনায় পৌঁছে গেছে। স্মরণ কর ঐ যুবক পুত্রদের, যাদের মরদেহের গোশত নেকড়ে, শিয়াল এবং চিল-শকুন খেয়ে উদরপূর্তি করেছে। যারা বন্দী হয়ে মদীনাবাসীর গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েছে। তাদের কথাও আজ বিশেষভাবে স্মরণ কর।… মুসলমানরা বিজয়ের নেশায় নির্ভীকভাবে এগিয়ে আসছে। তাদের জন্য এমন ভয়ঙ্কর বিপদে পরিণত হও। যেন তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। মহান সম্রাট উরদূশের নিজেই তোমাদের মোবারকবাদ দিতে আসবেন। তিনি তোমাদেরকে পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন।
শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও তার শৃঙ্গ পরিদর্শনের এক পর্যায়ে সে দূর থেকে এক অশ্বারোহীকে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসতে দেখে। দরজা খুলে দাও” আযাদাবাহ চিৎকার করে বলে “এই অশ্বারোহী আমিনিশিয়ার দিক থেকে আসছে।” একসাথে একাধিক আওয়াজ ওঠে “দরজা খুলে দাও, অশ্বারোহীকে ভেতরে আসতে দাও।” আযাদাবাহ অত্যন্ত দ্রুত প্রাচীর থেকে নেমে আসে। অশ্বারোহী পৌঁছার পূর্বেই নগরদ্বার খুলে দেয়া হয়। অশ্বারোহী গতি শ্লথ না করেই ভেতরে প্রবেশ করে। আযাদাবাহ ঘোড়ার পিঠে ছিল। সে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় এবং আগত অশ্বারোহীর দিকে এগিয়ে যায়। উভয় ঘোড়া পাশাপাশি এসে থেমে যায়।
“কোন খবর আছে?” আযাদাবাহ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“তারা আসছে” অশ্বারোহী হাঁফাতে হাঁফাতে বলে “সমস্ত সৈন্য নৌযানে চড়ে আসছে।”
অশ্বারোহী হযরত খালিদ বাহিনীর আগমনের খবর দিচ্ছিল।
“নৌযানে?” আযাদাবাহ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে “বাঁধ থেকে কত দূরে?”
“অনেক দূরে অশ্বারোহী জানায় “এখন পর্যন্ত অনেক দূরে আছে তারা।” আযাদাবাহর ছেলে সালার ছিল। সে ছেলেকে ডেকে পাঠায়। ছেলের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। “আযাদাবাহর ছেলে বলে ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
“আজ তোমার পরীক্ষার দিন প্রিয় বৎস!” আযাদাবাহ ছেলেকে বলে “এক অশ্বারোহী বাহিনী সাথে নিয়ে তুফানের চেয়েও দ্রুত গতিতে বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে যাও এবং সেখানে গিয়ে ফোরাতের পানি এমনভাবে চুষে নিবে যাতে ফোরাত শুকিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী নৌযানে করে আসছে। দেখব তুমি সেখানে প্রথমে পৌঁছাও নাকি মুসলমানরা!”
তার ছেলে এক অশ্বারোহী ইউনিট নিয়ে ঝড়ের বেগে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
***
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী বেশ দ্রুত গতিতেই আসছিল। বর্ষার মৌসুম না হওয়ায় নদীতে পানি তুলনামূলক কমই ছিল। তবে নৌযান চলার জন্য যথেষ্ট ছিল। আকস্মিক পানি কমতে শুরু করে। পানি কমতে কমতে এক সময় পূর্ণ শুকিয়ে যায় এবং সকল নৌযান কাদায় আটকে যায়। মদীনার মুজাহিদরা এতে শংকিত হয়ে পড়ে। চোখের সামনে এভাবে হঠাৎ করে নদী শুকিয়ে যাওয়া উদ্বেগজনক ব্যাপারই ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও চরম দুশ্চিন্তায় পড়েন।
“মোটেও ঘাবড়াবেন না জনাব খালিদ!” কূল থেকে হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আওয়াজ শোনা যায়। “মদীনাবাসী তোমরাও ভীত হয়ো না। নদীর অদূরে একটি বাঁধ আছে। আমাদের শত্রুরা বাঁধের সাহায্যে পানি আটকে রেখেছে।”
খুবই দ্রুত গতিতে নৌযানের আরোহীরা নৌযান থেকে ঘোড়া বের করে এবং একটি অশ্বারোহী দল জলদি বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। আযাদাবাহর ছেলে তখনও তার বাহিনীর সাথে সেখানে ছিল। মুসলিম অশ্বারোহী দল তাদের উপর একযোগে চড়াও হয় এবং একজনকেও জিন্দা রাখে না।
শত্রু নিধন শেষে মুসলমানরা পানির বাঁধ খুলে দেয়।
নৌযান পর্যন্ত পানি পৌঁছে গেলে নৌযানগুলো কাদামুক্ত হতে থাকে। মাঝি মাল্লারা হাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। নৌযান ভাসতে এবং সাতরাতে থাকে।
আযাদাবাহ সুসংবাদের অপেক্ষায় প্রাচীরে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে উঠছিল। তার এক সালার মাথা নীচু করে নিকটে এসে দাঁড়ায়।
“বড়ই দুঃসংবাদ এসেছে” সালার বলে।
“কোথা হতে” আযাদাবাহ হতচকিয়ে প্রশ্ন করে “তবে কি আমার পুত্র…।”
“মাদায়েন থেকে” সালার তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে “সম্রাট উরদূশের মারা গেছে। তবে এই খবর গোপন রাখতে হবে। সৈন্যদের জানানো যাবে না।”
ইতোমধ্যে এক অশ্বারোহী তাদের নিকটে আসে এবং ঘোড়া হতে নেমে নিয়মতান্ত্রিক শিষ্টাচার পর্ব শেষ করে।
‘কর্তব্য না হলে আনীত সংবাদ মুখে উচ্চারণ করতাম না” আগন্তুক আরোহী বলে।
“আমি তা শুনেছি” আযাদাবাহ বলে “কিসরা উরদূশের…।”
“না” অশ্বারোহী বলে “আমি এ খবর আনিনি। আমি যে মর্মান্তিক খবর এনেছি তা হলো, আপনার পুত্র বাঁধের ওখানে নিহত হয়েছে। তার সহযাত্রী সকল অশ্বারোহী মুসলমানদের হাতে নির্মমভাবে মারা গেছে।”
“আমার পুত্র!” আযাদাবাহর কম্পিত ঠোঁট থেকে এ শব্দ বের হয় এবং তার চেহারা লাশের মত ফ্যাকাশে হয়ে যায়।