হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং সূক্ষ্ম দূরদর্শীতার মাধ্যমে অনুধাবন করেন যে, তার সৈন্যদের স্বদেশ তথা মদীনা হতে ক্রমে দূরে সরে পড়া, প্রতিটি যুদ্ধের পর সৈন্যের হ্রাস এবং একের পর এক লড়াইয়ে সৈন্যদের ক্লান্তি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে তাদের নিয়ে লড়াই অব্যাহত রেখেছেন এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জলন্ত ইতিহাস ও নজির হয়ে রবে। অভিযানের মাঝপথে সমস্যা দেখা দিলে কিংবা লৌহবৎ প্রাচীর সম অন্তরায়ের সম্মুখীন হলে সেনাপতি তার বাহিনীকে ফেরৎ আনবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন দৃষ্টান্ত, ইতিহাস ও নজির সৃষ্টি করতে চান না।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সপক্ষে খেলাফতের পূর্ণ সমর্থন এবং সার্বিক সহযোগিতা ছিল। তৎকালীন যুগের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব কিংবা সমঝোতার কোনই অবকাশ ছিল না। শত্রুকে শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করা হত। শত্রু কত দূরে এবং কত শক্তিশালী তা মোটেও বিবেচ্য ছিল না। একমাত্র মৌলনীতি এটাই ছিল যে, দুশমনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড় এবং তার জন্য ত্রাস ও আতঙ্ক হয়ে যাও।
পারস্য সাম্রাজ্য কোন যেনতেন শক্তি ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই বিশাল শক্তির পেটে গিয়েও পিছু হটার কল্পনা করেননি। তিনি এটাও বিবেচনায় আনেননি যে, সৈন্যদেরকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দিবেন এবং তাদের শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতায় কোন ত্রুটি দেখা দিলে তা দূর করবেন। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হীরায় মোকাবিলা বড় কঠিন হবে জানালেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার চিন্তা মাথায় আনেননি। এবং তৎক্ষণাৎ তিনি সালারদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে তাদের ডেকে পাঠান।
“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সালারদের বলেন “আমার বিশ্বাস তোমরা এ চিন্তা করছ না যে, আমরা যতই অগ্রসর হচ্ছি আমাদের বিপদ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“না জনাব খালিদ!” এক সালার বলেন “আমাদের কেউ এমনটি চিন্তা করছে না।”
“আর আমাদের কেউ এমনটি চিন্তাও করবে না” অপর সালার বলেন।
“আমার এ বিশ্বাস আছে যে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তোমাদের কেউ এ চিন্তা করবে না যে, না জানি শত্রু কত শক্তিশালী।”
“না জনাব খালিদ।” সালার হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আপনি খুলে বলুন তো, আজ এমন কথা কেন বলছেন?”
“তোমার উপর আল্লাহর রহমত হোক!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমাদের পরবর্তী মঞ্জিল বড়ই দুস্তর। আল্লাহই ভাল জানেন, আমাদের মধ্য হতে কে জীবিত থাকবে আর কে দুনিয়া থেকে চলে যাবে। মনে মনে কল্পনা কর যে, নিজ জিম্মাদারী পালন না করে আল্লাহর সামনে গেলে তোমাদের ঠিকানা বড়ই খারাপ হবে।
তোমরা ভাল করেই জান যে, সেই ঠিকানা কি এবং কেমন দৃষ্টান্ত আজ তোমরা রেখে যাবে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হবে। আর এই দৃষ্টান্ত ইসলামের অস্তিত্ব সুরক্ষা কিংবা ধ্বংসের কারণ হবে। ইসলামের স্থায়িত্ব এবং তাকে চিরসমুন্নত রাখতে আমাদের লড়তে হবে। কুরআনের নির্দেশ স্মরণ কর, কুফরী ফিৎনা জগতে বিদ্যমান থাকা নাগাদ তোমরা অবিরত লড়তে থাক। আর শত্রু যখন অস্ত্র সমর্পণ করে তোমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন তাদের ক্ষমা করবে। অতঃপর তাদেরকে এমন কঠিন শর্ত পালনে বাধ্য কর, যাতে সে আর ছোবল দিতে না পারে এবং তার অন্তর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রেমিকদের ভয়ে কাঁপতে থাকে। সালারদের প্রেরণা নতুনভাবে চাঙ্গা করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের বলেন যে, সামনে ইরানীদের একটি বড় সামরিক ঘাটি রয়েছে। এর নাম হীরা। এখানকার শাসক আযাদাবাহ প্রচুর সৈন্য সমবেত করে রেখেছে। ইরানীরা প্রথম যুদ্ধে অসংখ্য নৌযান নিয়ে এসেছিল। সেগুলো বর্তমানে মুসলমানদের অধিকারে আছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সকল নৌযানে করে মুজাহিদদেরকে হীরায় নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পানিপথ তুলনামূলক সহজ, নিরাপদ ও নিকটবর্তী ছিল। এটাই ছিল সর্বপ্রথম যুদ্ধ যে যুদ্ধে মরুভূমির সিংহরা দরিয়ার পিঠে সওয়ার হয়।
নৌযানে আরোহিত সৈন্যদের হেফাজতের জন্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যে, নদীর উভয় তীর ধরে একশ থেকে দেড়শ অশ্বারোহীর ব্যবস্থা রাখেন। তারা গার্ড দিয়ে নৌচারীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। বিজয়ে উন্মাদ সৈন্যরা উজ্জীবিত প্রেরণা এবং ইসলামের ভালবাসার টানে ফোরাত নদীর বুকে চেপে চলছিল। রণসঙ্গীতের প্রতিধ্বনি ছিল যা ফোরাতের লহরের তালে তালে ভাব-বিহলতা সৃষ্টি করছিল। পরে এই সঙ্গীত কালেমা তৈয়্যেবায় বদলে যায়। ১৮ হাজার মুসলমানদের এক আওয়াজ, এক অভিলাষ এবং একই প্রেরণা ছিল। তাদের অন্তরে এক আল্লাহ এবং এক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা আর প্রেম ছিল।
শত্রু ঘুমিয়ে ছিল না। হীরার শাসনকর্তা আযাদাবাহ রাতেও নিদ্রা যেত না। সম্রাট উরদূশেরের মৃত্যুর খবর হীরায় জানানো হয় না। সে এখনও প্রতিটি কথা এবং প্রতিটি নির্দেশ দিতে গিয়ে উরদূশেরের নাম উচ্চারণ করত।