এই বৃদ্ধকে উটনীর দুধ পান করিয়ে নিজের অবস্থার উপর তাকে রেখে দেয়া হয়।
প্রায় সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, পুরো শহর এভাবে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল যে, গৃহস্থালী আসবাবপত্র এবং মূল্যবান বস্তু-সামগ্রী ঘরেই পড়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, ঘরের বাসিন্দারা ক্ষণিকের জন্য সদ্য কোথাও যেন গেছে। মানুষ পালানোর ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করে যে, টাকা-পয়সা এবং সোনা-রূপাও ফেলে যায়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে সমস্ত সৈন্যকে শহরে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাদেরকে গণীমতের মাল সংগ্রহ করার অনুমতি দেয়া হয়। এটা যেহেতু আমীর শ্রেণীর লোকদের অধ্যুষিত শহর ছিল, তাই ঘরে ঘরে মূল্যবান সম্পদ এবং বস্ত্রের সম্ভার ছিল। মুজাহিদরা কিছু কিছু জিনিস দেখে রীতিমত অবাক হচ্ছিল। এ সকল দামী বস্তু তারা স্বদেশে নিয়ে যাবার আগ্রহ ব্যক্ত করতে থাকে।
মাল-সম্পদ জমা করা হলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে থাকেন।
“আগুনে জালিয়ে দাও এসব বস্তু-সামগ্রী” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দিয়ে বলেন “এগুলো ভোগ-বিলাসের সামগ্রী ও উপকরণ। এ সব সম্পদই মানুষকে কাপুরুষ বানায়। তাদের পরিণতি দেখ। তাদের মহল এবং ঘর-বাড়ী দেখ। খোদার কসম! আল্লাহ যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে ভোগ-বিলাসিতায় নিক্ষেপ করেন।…
আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।… এ সকল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দাও। আর স্বর্ণ, হীরা অলঙ্কার, টাকা-পয়সা আলাদা জমা কর।”
আল্লামা তবারী রাহিমাহুল্লাহ বিশেষভাবে লিখেছেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ দিক লক্ষ্য করে মূল্যবান পাত্র, রেশমী কাপড় এবং শাসক শ্রেণীর গৃহস্থালীর আসবাবপত্র জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন, যেন এ সকল বস্তুর আকর্ষণ সৈন্যদের মনে প্রভাব ফেলে তাদেরকে যুদ্ধ হতে বিরত না রাখে। তবারী ছাড়াও অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও লিখেছেন যে, এই শহর থেকে যে পরিমাণ গণীমতের মাল পাওয়া যায় যা অন্য কোন স্থান থেকে এরপূর্বে অর্জিত হয় নাই। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিয়মানুযায়ী চার অংশ সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন। আর বাকী এক অংশ মদীনার বাইতুল মালের উদ্দেশে খলীফা হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর পাঠিয়ে দেন।
মুহাম্মাদ হুসাইন হায়কাল বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের সূত্রে লেখেন, মালে গণীমতের যে পঞ্চমাংশ মদীনায় প্রেরণ করা হয় তার নেতৃত্বে ছিল আযাল গোত্রের যানদাল নামক এক ব্যক্তি। ইরানীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতোপূর্বে তিন যুদ্ধে যে সকল ইরানী যুদ্ধবন্দী হয়েছিল মদীনায় প্রেরিত কাফেলায় তারাও ছিল। খলীফা হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হতে এক রূপসী বাঁদীকে যান্দালকে পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করেন।
আল্লামা তবারী লেখেন, খলীফা মদীনার মুসলমানদেরকে মসজিদে ডেকে তাদেরকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে অর্জিত বিভিন্ন বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ শুনান। তিনি বলেন “হে কুরাইশ জাতি। তোমাদের সিংহ আরেক সিংহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কুপোকাত করে ফেলেছে। এখন কোন নারী খালিদের মত সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম নয়।”
“জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে সম্বোধন করে বলেন, “সামনে পারস্য সাম্রাজ্যের আরেকটি বড় শহর হীরা রয়েছে। এ শহরটি পারস্যের সত্যিকার ‘হীরা’ বলা যায়। কিন্তু এটা পদানত করা সহজ হবে না।”
“ঠিকই বলেছ ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমিনিশিয়ার সমস্ত সৈন্য এবং সকল ইহুদী যুবক হীরায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে আমাদের মোকাবিলায় নেমে আসবে। আর তাদের আসাটাই স্বাভাবিক।… তা মাদায়েনের কি খবর?”
“আজই আমার এক গুপ্তচর ফিরে এসেছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তার বর্ণনা কিসরার প্রাসাদে এখনও মাতম চলছে।… সুসংবাদ হলো এখন আর সেখান থেকে কোন বাহিনী আসবে না।”
“এরা কি এখনো অনুধাবন করতে পারেনি যে, সিংহাসন, রাজমুকুট এবং ধনদৌলত এমন শক্তি নয়, যা শত্রুর হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “এটা কি আমাদের দায়িত্ব ও জিম্মাদারী নয় যে, এ সকল লোকের কানে আল্লাহর সত্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী পৌঁছে দেব যে, শক্তি এবং প্রাচুর্য কেবল আল্লাহর হাতে। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহই। তাঁর কোন অংশীদার নেই।”
“হ্যাঁ জনাব খালিদ।” হযরত মুসান্না বলেন “আল্লাহর পয়গাম তাদের পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।”
“এর সাথে সাথে আমি ঐ সম্ভাবনারও শিকড় উপড়ে ফেলতে চাই, যা ইসলামের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “কুফরের মূলোৎপাটন আমাকে করতেই হবে।”
ইসলামী ইতিহাসের এই প্রাথমিক যুগটি বড়ই স্পর্শকাতর ছিল। ইসলামের সমরেতিহাসের ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনার যুগ ছিল। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উম্মতের প্রগাঢ় ভালবাসা ও তার গভীরতার নজির স্থাপনের সময় ছিল এটি। এ ইতিহাসের ভিত্তি এই অকাট্য নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে যে, সংখ্যায় নগণ্য এবং শক্তির স্বল্পতা পরাজয়ের কারণ হতে পারে না। আদর্শিক চেতনা-প্রেরণা আর ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে।