অবশিষ্ট সৈন্যকে তিনি তিনভাগে ভাগ করে ফেলেন। পূর্বের মত ডান এবং বাম বাহিনীর নেতৃত্বে হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাখেন। তবে এবার তাদের দায়িত্ব ছিল ভিন্ন। শহরের দরজা খোলা থাকায় শহরের অভ্যন্তরে যাওয়া হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য জরুরী ছিল। হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার সাথে সাথেই থাকতে হয়। যাতে প্রয়োজনের মুহুর্তে তিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে কেল্লার চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বলা হয়।
পরিকল্পনা চূড়ান্ত এবং সকলের পজিশন ও দায়িত্ব বণ্টন শেষে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
***
তিনভাগে বিভক্ত বাহিনী একসাথে শহরের নিকট পর্যন্ত গিয়ে এরপরে সবাই পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। হযরত মুসান্নার জানবায সৈনিকেরা শহরের বাইরের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরছিল। পাশেই একটি বন ছিল। কিছু এলাকা ছিল খাঁ খাঁ প্রান্তর। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীকেও কয়েকটি দলে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এসব ক্ষুদ্র টিম ঐ সকল স্থান তল্লাশি করে ফেরে যেখানে শত্রুর লুকানোর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কোথাও শত্রুর নাম-গন্ধ পাওয়া যায় নি। অতঃপর তারা দূর দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
সৈন্যদের তিনও অংশ শহরের প্রাচীরের নিকট পৌঁছলে সালার হযরত আদী ইবনে হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীকে শহরের চতুর্দিকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করান যে, শহরের লোকজন যেন বাইরে বেরিয়ে আসে। “শহরবাসী বেরিয়ে না এলে একটি ঘরও আস্ত রাখা হবে না। সব ধুলিস্মাৎ করে দেয়া হবে।” “অগ্নিপূজারীরা! বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে এস।”
“সালারদের বল, তারা যেন কাপুরুষতার পরিচয় না দেয়।”
এভাবে একের পর এক ঘোষণা হতে থাকে। কিন্তু দরজার ওপাশে পূর্ববৎ নীরবতা বিরাজ করতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খাঁপ থেকে তলোয়ার টেনে বের করেন। উচ্চ আওয়াজে বলেন, “আমার পিছনে পিছনে এস।” এরপর তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। যে সমস্ত সৈন্য তাঁর সাথে ছিল তারা বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত শহরের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সর্বাগ্রে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল।
ভেতরে ঢুকেই ঘোড়াগুলো ছড়িয়ে পড়ে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রতিটি ঘরে তল্লাশী চালাতে বলেন। তিনি নিজে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে যান এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকেন। তিনি সালার হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর এই পয়গাম দিয়ে দূত পাঠান যে, তিনি যেন নিজ বাহিনীকে ভিতরে নিয়ে আসে এবং পদাতিক তীরন্দাজদেরকে শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীরে ছড়িয়ে দেন।
মুহূর্তে হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তীরন্দাজ ইউনিট সমস্ত প্রাচীরের উপর ছড়িয়ে যায়। তারা ভিতর-বাহির উভয় দিক খেয়াল রাখছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রাচীরের উপরে ওঠেন এবং শহরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে আসেন। শহরের অভ্যন্তরে নিজের সৈন্য ছাড়া অন্য কেউ তার নজরে আসেনা। বাইরে হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী পূর্ণ সতর্কাবস্থায় ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি যতদূর যায় শত্রুর কোন নাম-নিশানা তার চোখে পড়ে না। বহু দূরে দু’তিন অশ্বারোহী দল তিনি দেখতে পান। তারা হযরত মুসান্নার বাহিনী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপর থেকে ভেতর বাহির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নীচে নেমে আসেন। এ সময় তাকে জানানো হয় যে, এক দুর্বল লোক একটি ঘরের খাটে শুয়ে কাতরাচ্ছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত সে ঘরে গিয়ে হাজির হন। লোকটি ছিল অত্যন্ত বৃদ্ধ। তার চোখ আধা খোলা ছিল। মুখও খোলা। খাটে পড়ে থাকা লাশ মনে হচ্ছিল। তার আওয়াজ ছিল ফিসফিস। সে কিছু বলছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর এক দেহরক্ষীকে বৃদ্ধ লোকটির মুখের কাছে কান লাগিয়ে তার কথা শুনতে বলেন।
“যাদের ভয়ে শহর জনশূন্য তোমরা কি তারা?” বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করে।
“আমরা মুসলমান” দেহরক্ষী বলে।
“মদীনার মুসলমান? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করে এবং জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে “আমি এখানকার একজন ইহুদী। ধুকে ধুকে মরার জন্য তারা আমাকে এখানে রেখে গেছে। শহরের সবাই চলে গেছে।”
“কোথায় চলে গেছে?” দেহরক্ষীর প্রশ্ন।
“পালিয়ে গেছে” বৃদ্ধ বলে “সালার, সৈন্যরা পালিয়ে গেলে সাধারণ জনতা না পালিয়ে যাবে কোথায়? খালিদ বিন ওলীদ কি তোমাদের সেনাপতি?… এখানকার সবাই তাকে জ্বিন এবং দৈত্য মনে করে।…হ্যাঁ, ঠিকই।… কিসরার শক্তিশালী ফৌজকে যে এভাবে পরাস্ত করতে পারে সে মানুষ হতে পারে না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে বলেন না যে, যাকে তারা জ্বিন বা দৈত্য মনে করে সে তার সামনে দাঁড়ানো। তিনি তথ্য সংগ্রহের পর তাকে দুধ পান করানোর নির্দেশ দেন।
“সৈন্যরা গেল কোথায়?” বৃদ্ধের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
“সামনে হীরা নামে একটি শহর আছে” বৃদ্ধ জবাবে বলে “আমাদাবাহ তার শাসক। হয়ত সেই নির্দেশ দেয় যে, লোকজন যেন সব হীরায় চলে আসে।… আমাদের এই শহরের যুবকরা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল। অধিকাংশ মারা গিয়েছে। যারা প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিল তারা সবাই হীরা চলে গিয়েছিল। বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুরা ছিল এখানে। এখানকার লোক খালিদ বিন ওলীদের নামে ভয়ে কম্পমান। পলায়নপর যুবকরা এই ভীতি আরো ব্যাপকতর করে। তারা বলত, মুসলমানরা রক্তের নদী বইয়ে দেয়। তারা এদিকেই এগিয়ে আসছে।… এরপর সবাই পালিয়ে যায়। কেউ এখানে থাকার সাহস করেনি। পালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি দাঁড়াতেও পারি না। তারা এখানে আমাকে মরার জন্য ফেলে রেখে গেছে।”