হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিজের তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে সামনে কোন শহর আছে কিনা জানতে চান।
“কিছুদূর পরেই ইরানের একটি বড় শহর আমিনিশিয়া আছে” হযরত মুসান্না বলেন “পারস্যের ফৌজ এখানে থাকার কারণে শহরটিকে বড় একটি সামরিক ঘাটি বলা যেতে পারে। শহরটি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রও বটে। এর আশে-পাশের ভূখণ্ড অত্যন্ত উর্বর। বাণিজ্য তরি-তরকারি এবং বাগিচার ফল-মূলের কারণে আমিনিশিয়া শাহী শহর বলে খ্যাত। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত মজবুত। শহরের ফটকও ইস্পাতদৃঢ়। প্রাচীরের কাছে ভিড়তে চেষ্টা করলে তীরবৃষ্টি হয়।… জনাব খালিদ এই শহর পদানত করতে ব্যাপক জান-মালের কুরবানী দিতে হবে। আপনি এই শহর করায়ত্ত করতে পারলে মনে করবেন, শত্রুর একটি মোটা রগ আপনার হাতে মুষ্টিবদ্ধ।” “এখনও সেখানে সৈন্য আছে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান– “যদি থাকে তাহলে তারা সংখ্যায় কত হবে?”
“যে পরিমাণ পূর্বে ছিল তেমনটি এখন নেই” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন “আমার জানা মতে উলাইয়িস যুদ্ধে এ শহর থেকেও কিছু সৈন্য নেয়া হয়েছিল।”
একটি ছোট নদী এঁকে-বেঁকে ফোরাত নদীতে গিয়ে মিলত। নদীটির নাম ছিল বাদকলি। এই নদীর সঙ্গমস্থলের উপকূলে অমিনিশিয়া শহরটি অবস্থিত ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মর্মে মর্মে অনুধাবন করেন যে, তাঁর প্রতিটি অগ্রবর্তী কদম পূর্ববর্তী কদম থেকে কঠিন হয়ে উঠছে। তদুপরি তিনি নির্দেশ দেন যে, এখনই আমিনিশিয়া অভিমুখে মার্চ কর। তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দানের পিছনে তার উদ্দেশ্য ছিল, ইরানীদের সামনে এগুবার সুযোগ না দেয়া।
॥ সতের ॥
৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিন। খালিদ বাহিনী এ দিনে উলাইয়িস থেকে রওনা হয়। মদীনার মুজাহিদগণ বিজয়ী ফৌজের মর্যাদায় অভিষিক্ত। পরবর্তী মঞ্জিল সবুজ-শ্যামলিমা এবং যথেষ্ট উর্বর ছিল। মানুষ এবং অশ্বের খাদ্যের কোন ঘাটতি ছিল না। তবে আমিনিশিয়ার প্রতিরক্ষার দিকটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছিল।
শহরের প্রাচীর আর কেল্লাশৃঙ্গ নজরে আসতে থাকলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের থামার নির্দেশ দেন। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু মূল বাহিনী থেকে আগেই পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি গেরিলা আক্রমণে অত্যন্ত পটু ছিলেন। অনুগত বাহিনীও তার সাথে সাথে ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কাঁধে এ দায়িত্ব অর্পণ করেন যে, যে কোন বেশে কিছু লোক আমিনিশিয়া পাঠিয়ে সেখানে কত সৈন্য আছে তা যেন জানতে চেষ্টা করে।
একটু পরেই হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে আসেন।
“জনাব খালিদ!” তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন “আমার বিশ্বাস এটা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। মনে হয়, ইরানিরা সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে এখন থেকে ধোঁকা এবং প্রতারণামূলক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“আগে তো বল, তুমি কি দেখে এসেছ?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন “আর সে ধোঁকা কেমন, যা ইরানীরা আমাদের দিচ্ছে?”
“পুরো শহর ফাঁকা” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “শহরের ফটক উন্মুক্ত। কেল্লাশৃঙ্গ এবং প্রাচীরে একজনেরও পাত্তা নেই।”
“তোমার লোকেরা শহরের ভেতরে গিয়েছিল?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।
“না, জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন “তারা ফটক পর্যন্ত গিয়েছিল। শহর কবরস্থানের মত খাঁ খাঁ করছিল। তারা বলছে দরজা দিয়ে তারা কোন মানুষ কিংবা পশুর দেখা পায় নি।… আপনার মতে এটা কি প্রতারণা বা ফাঁদ নয়?”
“হ্যাঁ ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তোমার লোকদের ব্যাপারে আমি এই সন্দেহ করতে পারি না যে, তারা মিথ্যা বলছে। তারা স্বপ্ন না দেখে থাকলে আমাদেরকে সতর্কতার সাথে সামনে অগ্রসর হতে হবে।”
“খোদার কসম! তারা মিথ্যা বলার মত লোক নয়” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ়তার সাথে বলেন “তাদের ঈমান এত দুর্বল হলে ইরানীদের জুলুম নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা অনেক পূর্বেই ইসলাম ত্যাগ করত।… আর শুনে রাখুন জনাব খালিদ। সবার পূর্বে আমার লোকেরাই শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। যদি এটা ধোঁকা, ফাঁদ কিংবা প্রতারণা হয়ে থাকে তবে এর শিকার প্রথমে আমার লোকেরাই হবে। আপনার সৈন্যরা নিরাপদ থাকবে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সালারদের ডেকে পাঠান এবং তাদেরকে অবহিত করেন যে, আমিনিশিয়া ফাঁকা; জনশুণ্য। এটা প্রতারণা হতে পারে।
“ধোঁকা এই ছাড়া আর কি হবে যে, শহরের ফটক খোলা দেখে আমরা তার মধ্যে ঢুকে পড়ব” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “সবাই ঢুকে পড়লে হঠাৎ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে আর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে যাব।…আমরা শীঘ্রই শহরে আক্রমণ করতে যাচ্ছি।… ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সম্বোধন করে বলেন “তোমার বাহিনী মূল সৈন্যদের থেকে দূরে থাকবে। তোমার দৃষ্টি সর্বদা সৈন্যদের উপর থাকবে। দুশমন কোথাও হতে বের হয়ে এলে তোমার বাহিনী নিজেদের যোগ্যতানুযায়ী হামলা করবে। গেরিলা ধরনের আক্রমণ তারা করতেই থাকবে। তোমাকে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।”