“কোন কিছুতেই কিছু হবে না। মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” ডাক্তার বলে–“কোন কিছু করে লাভও নেই। মুসলমানদেরকে পারস্যের সীমানা হতে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে–এই খবরটুকু শুধু এনে দিন। কিংবা খালিদ বিন ওলীদকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে কিসরার সামনে এসে উপস্থিত করুন, দেখবেন কিসরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন।”
“এমন খবর কোথা থেকে আনব।” সম্রাজ্ঞী আশাহত এবং পরাজিত কণ্ঠে বলে, “মদীনার এই সেনাপতিকে কিভাবে জিঞ্জিরে বেঁধে আনব?… আমার সেনাপতি যদি পরাজিত হয়ে জীবিত ফিরে আসত, তবে আমি তার পা মাটিতে পুঁতে তাকে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিতাম।”
অতঃপর সে মাথা নীচু করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। চিকিৎসকের কথার রূঢ় বাস্তবতা সে সহ্য করতে পারে না।
***
একটি ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসে এবং শাহী মহলের বহির্ভাগে এসে থামে। সম্রাজ্ঞী অশ্বের খুরধ্বনি শুনেই বাইরে বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধ চিকিৎসকও তার পিছনে পিছনে ছুটে আসে। আগত অশ্বারোহী একজন কমান্ডার। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমেই সে সম্রাজ্ঞীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তার মুখ খোলা এবং চোখ সাদা হয়ে গিয়েছে। চেহারায় শুধু ক্লান্তিই নয়; আতঙ্কও বিরাজ করছিল।
“কোন সুসংবাদ এনেছ?” সম্রাজ্ঞী জিজ্ঞাসা করে এবং রাজকীয় দাপটের সাথে বলে “উঠে বস এবং জলদি বল।”
কোন ভাল খবর নেই” কমান্ডার বড় বড় শ্বাস ফেলে বলে “মুসলমানরা সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করেছে। তারা আমাদের হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে খুসাইফ নদীর পাড়ে এমনভাবে হত্যা করেছে যে, নদীতে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে। নদী শুষ্ক ছিল। মুসলমানদের সেনাপতি উপর থেকে নদীর বাঁধ খুলে দিলে নদীতে রক্তের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়।” “আপনি কেন জীবিত ফিরে এলেন?” সম্রাজ্ঞী ক্রুদ্ধকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি আমার হাতে নিহত হতে এখানে এসেছেন?”
পরবর্তী যুদ্ধে লড়ার জন্য আমি জীবিত ফিরে এসেছি” কমান্ডার জবাবে বলে “আমি লুকিয়ে আমাদের সৈন্যদের মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছি।”
“সাবধান!” সম্রাজ্ঞী নির্দেশের সুরে বলে “এই সংবাদ আর কোথাও যেন রাষ্ট্র না হয়। পারস্য সম্রাটকে…।”
“পারস্য সম্রাট এই খবর শোনার জন্যই কেবল জীবিত আছে” উরদূশেরের আওয়াজ ভেসে আসে।
সম্রাটের আওয়াজ পেয়ে সম্রাজ্ঞী এবং চিকিৎসক উভয় বিস্ফোরিত নেত্রে আওয়াজের উৎস পথে চায়। একটি পিলারে ভর দিয়ে তাদের অদূরেই সম্রাটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। দুই অপূর্ব সুন্দরী এবং তন্বী যুবতী সম্রাটের হাত নিজেদের কাঁধে স্থাপন করে রেখেছিল।
“এখানে এস” সম্রাট কমান্ডারকে নির্দেশ দেয় “আমি অনুমান করেছিলাম হয়ত বা কোন দূত এসেছে।…বল, কি খবর এনেছ?”
কমান্ডার পালাক্রমে সম্রাজ্ঞী এবং চিকিৎসকের দিকে তাকায়।
“এদিকে তাকাও” উরদুশের গর্জে উঠে বলে “সংবাদ শুনাও।”
কমান্ডার নিরুপায় হয়ে এক এক করে সকল ঘটনা খুলে বলে। পরাজয়ের সংবাদ শুনার সাথে সাথে উরদূশেরের মাথা সামনের দিকে হেলে যায়। বাহু ধরে রাখা দু’নারী সম্রাটকে ভর দিয়ে রাখে। সম্রাজ্ঞী ছুটে এসে সম্রাটের হেলে পড়া মাথা উপরে তুলে ধরে। বৃদ্ধ চিকিৎসক সম্রাটের নাড়িতে হাত রাখে। সম্রাজ্ঞী অসহায়ভাবে চিকিৎসকের দিকে তাকায়। চিকিৎসক নিরাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।
“পারস্য সাম্রাজ্য কিসরা উরদূশের থেকে চির বঞ্চিত হয়ে গেছে” চিকিৎসক কান্নাঝরা কণ্ঠে বলে চোখ মুছে।
মুহূর্তে শাহী মহলে হুলস্থুল পড়ে যায়। কান্নার রোল ওঠে। উরদূশেরের লাশ হাতে হাতে তার ঐ কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে বসে সে কয়েকবার বলেছিল আরবের ঐ লুটেরা বুদ্দুদের ইরান সাম্রাজ্যে পা রাখবার সাহস কিভাবে হল। সে এই কামরায় বসে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু কে জীবিত অথবা মৃত উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। এ নির্দেশ প্রতিপালিত হওয়ার পূর্বেই তার লাশ পড়েছিল এই কামরায়। পরাজয়ের ক্রমাঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল।
সম্রাজ্ঞী নির্দেশ জারী করে যে, লড়াইরত সৈন্যরা যেন কিসরার মৃত্যুর খবর জানতে না পারে। মুসলিম শিবিরে একটি ঘোড়া ছুটে এসে প্রবেশ করে। অশ্বারোহী জোরে চিৎকার করে বলছিল।
“জনাব খালিদ কোথায়?” ঘোড় সওয়ার দু’হাত উঁচু করে নাড়াতে নাড়াতে আসছিল “বাইরে আসুন জনাব খালিদ!”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুতবেগে বাইরে আসেন।
“জনাব খালিদ” আরোহী বলতে বলতে আসছিল, “আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনার আতঙ্ক উরদূশেরের জীবন সংহার করেছে।” “তুমি উন্মাদ হয়ে গেলে ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে গিয়ে বলেন। আগত আরোহী ছিলেন মুসান্না ইবনে হারেসা। তিনি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামেন এবং এত আনন্দে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে রক্ষা পান। “মাদায়েনে শোক বইছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু আনন্দের আতিশয্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে বলেন “শাহী মহল এখন কান্নার মহলে পরিণত। উরদূশের মারা গেছে চার দিন আগে। আমার দু’ব্যক্তি মাদায়েনের শাহী মহলে ছিল। সেখানে কড়াভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, যেন সৈন্যদেরকে কিসরার মৃত্যুর সংবাদ জানানো না হয়।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দুহাত আসমান পানে তোলেন। আমার মাওলা!” তিনি বলতে থাকেন “আপনার শুকরিয়া আদায় করার ভাষা আমার নেই। বিজয়ের গর্ব-অহংকার থেকে আমাকে দূরে রাখুন। পরওয়ারদেগার! সকল প্রশংসা আপনার। আপনিই সমস্ত প্রশংসার উপযুক্ত।হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত নীচে নামান এবং এদিক-ওদিক তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেন “সমস্ত সৈন্যকে এ সংবাদ জানিয়ে দাও যে, পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্যের স্তম্ভ ভেঙ্গে পড়েছে। আর এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর অনুগ্রহ। সবাইকে জানিয়ে দাও যে, তোমাদের ভীতি ও আতঙ্ক কিসরার প্রাণ হরণ করেছে।”