“শব্দ, কেবল শব্দ” সম্রাজ্ঞী গালিচায় পা জোরে ছুঁড়ে বলে “নিষ্প্রাণ শব্দ মাত্র।… শুধু গালভরা বুলি কোন দুঃখীর দুঃখ মুছে দিতে পারে? কোন রুগ্ন ব্যক্তিকে তার রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে? আপনার মুখে এমন শক্তি আছে যে, কিসরার রোগ চুষে নিতে পারে?”
“না মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” চিকিৎসক বড় ধৈর্যের সাথে বলে এবং কম্পিত হাতে সম্রাজ্ঞীর বাহু ধরে তাকে বসিয়ে বলে “কেবল বুলি কারো দুঃখ এবং কারো রোগ নিরাময় করতে পারে না। তবে দুঃখ এবং রোগের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করে থাকে। বাস্তবতার সামনে শব্দের কোন অর্থ নেই। আর বাস্তবতা যদি রূঢ় ও বিস্বাদ হয় তবে জ্ঞানীর মুখ থেকে নির্গত শব্দ মনে হয়, যেন হেমন্তের গোধূলিতে বৃক্ষের হলুদ পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে। শুকনো ঐ পাতা আবার বাতাসের দোলায় হেলে-দুলে নাচতে থাকে।”
“আমরা কিসরাকে বাস্তব থেকে দূরে রাখছি” সম্রাজ্ঞী বলে “আমি তাকে গান বাদ্যে ভুলিয়ে…।”
“কিন্ত কতদিন নাগাদ? “বৃদ্ধ চিকিৎসক তার কথার মাঝপথে কেটে দিয়ে বলে “মাননীয় সম্রাজ্ঞী! আপনারা কিসরা হতে রুঢ় বাস্তবতা কতদিন গোপন করে রাখবেন। এই নৃত্য, গান এবং মখমলের মত নরম ও যৌবনদীপ্ত শরীর কিসরা উরদূশের মন ভুলাতে পারবে না। কিসরা কেবল সম্রাট হলে তিনি নিজেকে চমৎকারভাবে প্রতারিত করতে পারতেন। পালিয়ে গা বাঁচাবার সুগম পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেবল সম্রাটই নন; বীরযোদ্ধাও বটে। তার ঘোড়ার পদভারে জমীনের তলদেশে কম্পন তুলেছিল। পারস্যের এই বিশাল সাম্রাজ্য কিসরার বাহুবলেরই ফসল। এই সম্রাজ্য তিনি রোমীয়দের শক্তিশালী সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিসরা নিজেও অস্ত্র ধারণ করেছেন। ভয়ানক যুদ্ধ করেছেন। ঘুমন্ত সেই সিংহ এখন জাগ্রত। এতদিন তিনি বিলাসিতায় বিভোর থাকলেও এখন তিনি সতর্ক। ফলে নৃত্য, গান এবং জাদুরূপী নারী সবই তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এখন তিনি কোন নর্তকী কিংবা কণ্ঠশিল্পী নয়; বরং হুরমুজ, আন্দারযগার, বাহমান এবং আনুশাযানকে ডেকে ফিরছেন।… কোথায় এখন তার এ সকল শ্রেষ্ঠ সেনাপতিরা? আপনি তাকে কিভাবে ধোঁকা দিবেন?”
“না, না,” সম্রাজ্ঞী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “ধোঁকা দিয়ে আর কি লাভ।… আপনি ঠিকই বলেছেন।… কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কি? আমার মাথায় কিছুই আসছে না। আমাদের প্রতিপক্ষ ঐ মুসলমানদের সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? কয়েকজন ইহুদী এসেছিল। তারা মন্তব্য করছিল, মুসলমানদের এমন এক ভরপুর শক্তি আছে যার মোকাবিলা করার সামর্থ্য কারো নেই।… আর আমি লক্ষ্য করেছি যে, দজলা আর ফোরাতের সংগমস্থলে যে সকল মুসলমানকে পুনর্বাসিত করে তাদেরকে আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছিলাম এবং যাদেরকে আমরা কীট-পতঙ্গের ঊর্ধ্বে জানতাম না, তারাই আজ মদীনাবাসীর শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের সৈন্যরা তাদের সামনে দিয়ে বকরীর মত পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
“এটা চেতনা-বিশ্বাসের শক্তি মাননীয় সম্রাজ্ঞী।” বৃদ্ধ চিকিৎসক বলে “একটি কথা বলতে চাই, যদিও তা আপনার ভাল লাগবে না। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, বাদশাহীর অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালার। পৃথিবীর সকল মানুষ তাঁরই আজ্ঞাবহ।… তারা আরো বলে যে, সেই আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।… আপনি এই রহস্যের গূঢ় তথ্য বোঝেন মাননীয় সম্রাজ্ঞী?
“না, জনাব চিকিৎসক।” সম্রাজ্ঞী জবাবে বলে “আমি আপনার কথার মর্মার্থ সম্বন্ধে অবগত নই। আমি সাধারণভাবে যা বুঝি তা হলো, বাদশাহী একটি খান্দানী ব্যাপার। খান্দানের সদস্যরাই পর্যায়ক্রমে বাদশাহ হয়।”
এই খান্দানী রীতির করুণ পরিণতি আপনি নিজে চোখে দেখছেন মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” চিকিৎসক বলে “যিনি নিজেকে জনগণের সম্রাট বলে মনে করতেন আজ তিনি নির্জীব, নিষ্প্রাণ হয়ে ভেতরে পড়ে আছেন। স্বীয় রাজত্ব শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। তার সেনাবাহিনী শুধু পিছপাই হচ্ছে। বেচারা সিপাহীদের এত কি দায় ঠেকেছে যে, একটি খান্দান এবং ব্যক্তির রাজত্বের জন্য নিজেদের জীবন-যৌবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবে? হাজার হাজার যারা মারা যাচ্ছে অধিকাংশই পালাতে গিয়ে মরছে। তারা যখন দেখছে যে, এখানে যুদ্ধে জয়ী হবার বেলায়ও মালে গণীমত নেই তখন তারা লড়তে দ্বিধা করছে। তারা আপনাদের সরকারী কোষাগার হতে মাসিক বেতন লাভের উদ্দেশ্যে জীবিত থাকতে চায়।”
“আর মুসলমানরা?” সম্রাজ্ঞী উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
‘মুসলমানরা!” চিকিৎসক বলে “তারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে লড়ে না। তারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লড়ে এবং সেনাপতির নির্দেশ মেনে চলে। বস্তুত এ কারণেই সংখ্যায় স্বল্প হয়েও তারা তুফানের গতিতে ধেয়ে আসছে।… মাননীয় সম্রাজ্ঞী! প্রত্যেকের চেতনা-বিশ্বাস এবং মাজহাব ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমি জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার কথা বলছি। যখন কোন খান্দান কিংবা কোন ব্যক্তি নিজেকে রাজাধিরাজ জ্ঞান করে এবং অন্য মানুষকে মানুষ বলে গ্রাহ্য করা ভুলে যায় তখন একদিন এমন আসে যখন সে সমস্ত সৈন্য এবং জনগণকে ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের গভীর আবর্তে নিক্ষেপ করে।”
‘আমি এসব সূক্ষ্ম কথা বুঝি না” সম্রাজ্ঞী বলে “এবং বুঝতেও চাই না। আমি শুধু চাই, যে কোন উপায়ে কিসরা সুস্থ হয়ে উঠুক। এর জন্য যা যা দরকার তা করুণ মাননীয় চিকিৎসক।