যে নদীর কূলে এই হত্যাকাণ্ড চলে সেখানে একটি বাঁধ ছিল। এই বাঁধের ফলে নদীর পানি থমকে ছিল; পানির প্রবাহ ছিল না। যার দরুণ রক্তও জমে থাকছিল পানিতে বয়ে যাচ্ছিল না। এক ব্যক্তি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে পরামর্শ দেয় যে, এই বাঁধ খুলে দিলে তবেই রক্তের নদী বইবে; নতুবা বইবেনা। অতঃপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে নদীর বাঁধ খুলে দেয়া হয়। হাজার হাজার মানুষের রক্ত নদীতে পড়লে পানি লাল হয়ে যায় এবং পানি বাঁধ মুক্ত হয়ে স্রোতের বেগে বইতে থাকে। এ কারণে ইতিহাসে এ দরিয়াকে ‘খুনের দরিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কোন কোন ঐতিহাসিকদের অভিমত, পলায়নপর এবং আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদেরকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ কারণে গণহারে হত্যা করেন যে, এই সৈন্যরা এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার পরবর্তী রণাঙ্গনে উপস্থিত হত। এর প্রতিষেধক হিসেবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সিদ্ধান্ত নেন যে, এবার একজন সৈন্যকেও জীবিত রাখা হবেনা। বলা হয়, একাধারে তিন দিন পর্যন্ত ইরানী এবং ইহুদীদের গণহত্যা চলতে থাকে। এভাবে নিহতদের সংখ্যা যোগ করে এ যুদ্ধে ইরানী এবং ইহুদী সৈন্যদের নিহতের সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ হাজার।
৪.১৬ সম্রাট উরদূশের রোগ
॥ ষোল ॥
ন্যায় বিচারক নওশেরওয়াঁর পৌত্র সম্রাট উরদূশের এমন রোগের কবলে পড়ে যার চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় চিকিৎসকদের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। এই রোগের সূচনা হয় পরপর তিন পরাজয়ের কঠিন মানসিক আঘাত থেকে। কিন্তু এই মানসিক অসুস্থতা এখন দৈহিক অসুস্থতার রূপ পরিগ্রহ করে। ঔষধেই এ রোগের চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, যেন সে ঔষধ নয়; বরং ঔষধই তাকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
উরদূশেরের উপর নীরবতা ছেয়ে যায়। নিজ যুগের প্রতাপশালী ফেরাউন হওয়া সত্ত্বেও এখন তার অবস্থা মরুভূমির আলোর মত নিভু নিভু। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিল, যেন যুদ্ধ সংক্রান্ত কোন খারাপ সংবাদ উরদূশের পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব ছিল না। কারণ, কখনো মুখ খুললে প্রথমে সে এ কথাই বলত যে, রণাঙ্গনের কোন খবর এল কি?
“সুসংবাদই আসছে জাঁহাপনা!” সর্বদা পাশে উপস্থিত চিকিৎসক তাকে জবাব দিত এবং তাকে বাঁচাতে কখনো বানিয়ে বলত “মুসলমানরা এভাবে পিছু হটছে যেন কোন দৈত্যের মুখোমুখি হয়েছে তারা। আবার কখনো বলত “পারস্য সাম্রাজ্য একটি অজেয় প্রান্তর। এ প্রান্তরে যেই মাথা ঠুকতে চেষ্টা করেছে তার মাথা ছিদ্র হয়েছে। আবার কখনো তার প্রাণের রাণী এই বলে তাকে প্রবোধ দিত যে, “আরবের বুদ্দুরা কিসরার শৌর্য-বীর্যের প্রতাপ কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।”
এই প্রবোধ ও সান্ত্বনামূলক বাক্য কিসরার উপর ঔষধের মত উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে থাকে। কোন কিছুতেই তার নীরবতা ভঙ্গ হয় না। এবং চেহারায় উদাসীনতার ছাঁপ হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমে তা গভীর থেকে গভীর হতে থাকে।
তার একান্ত পছন্দের নর্তকী তার সামনে গিয়ে রূপ-নাগিনীর মত দেহে ঢেউয়ের উত্তাল তরঙ্গ তোলে। শরীর অর্ধনগ্ন করে দেয়। উরদূশেরের ম্রিয়মান চেহারার উপর সুগন্ধিযুক্ত রেশমের মত মোলায়েম কেশদাম ছড়িয়ে ছায়া বিস্তার করে। অতঃপর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে নাচের ঝড় তোলে। রূপ-লাবন্যে মোহিত করে কিসরার রুগ্ন সন্তানকে প্রাণবন্ত করে তুলতে প্রয়াস পায়। কিন্তু ফলাফল জিরো। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, যেন নর্তকী বিজন জঙ্গলে নেচে চলছে আর তার নাচের নৈপুণ্য জঙ্গলের হাওয়ায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে।
একসময় তার প্রিয় শিল্পীরা যারা তাকে গানে গানে মাতিয়ে দিত এবং দারুণ বিমোহিত করত এ সময় তাদের প্রাণ মাতানো গানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ সকল নর্তকী এবং শিল্পীরা পারস্য খ্যাত ছিল। পারস্যের ভুবনখ্যাত সুন্দরী-রূপসীরা হরমে ফুলের মত প্রস্ফুটিত ছিল। এদের কতক আবার অর্ধ-উম্মিলিত ফুলকলিও ছিল। উরদূশের এ সমস্ত প্রস্ফুটিত উম্মিলিত ফুল ও তার কলির নাদুস-নুদুস শরীরের ঘাণে দিন-রাত বিভোর থাকত। কিন্তু এখন তাদেরই এক একজন করে তার নির্জন সঙ্গীরূপে গেলেও সে কাউকে মনোরঞ্জনের সাথীরূপে বরণ করেনা। কেউ তার দেহ মনে নয়া যৌবনের তুফান তো দূরে থাক বিন্দুমাত্র উষ্ণ শিহরণ জাগাতে পারে না।
‘ব্যর্থ, সকল চেষ্টা ব্যর্থ” পারস্য-রাণী বাইরে এসে ঐ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসকের কাছে ব্যর্থতা প্রকাশ করে বলে, যার সম্পর্কে সবাই জানত যে, তাকে দেখে মৃত্যুও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রাণী দরাজগলায় চিকিৎসককে বলে আপনার জ্ঞান-অভিজ্ঞতাও ফেল হয়ে গেল? এটা কোন রং তামাশা নয় তো? কিসরার ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা আনতেও কি আপনি পারেন না? কে বলে, আপনার ছোঁয়ায় মৃত্যুও জেগে ওঠে?”
যরথুস্ত্র আপনার প্রতি সদয় হোন পারস্য-সম্রাজ্ঞী।” বয়োবৃদ্ধ চিকিৎসক মুখ খোলে কারো জীবন-মৃত্যু আমার হাতে নয়। আমি জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক দুর্বল প্রাচীর মাত্র। মৃত্যুর হাত এত মজবুত ও শক্তিশালী যে, সে ঐ প্রাচীরকে দরজার খিলের মত খুলে ফেলে এবং অসুস্থ ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায়। মৃত্যুর এই শক্তির সামনে আমার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা তুচ্ছ হয়ে রয়ে যায়।”