‘বনূ বকর!” যুদ্ধের ময়দানে একটি ঘোষণা শোনা যায়। “এবং যরথুস্ত্রের পূজারীরা! দৃঢ়পদে লড়াই চালিয়ে যাও। মাদায়েন থেকে বাহমান সৈন্য নিয়ে আসছে।”
ঘোষক থেকে থেকে ঘোষণাটি বারবার সম্প্রচার করতে থাকে। ঘোষণাটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বিচলিত করে তুলছিল। তিনি দূত মারফৎ পার্শ্বদ্বয় বাহিনীর সালারদের সবদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রিজার্ভ বাহিনীকেও পূর্ণ সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, পাশ্চাৎ হতে আক্রমণের আশংকা রয়েছে।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের অভিমত, বাহমান মাদায়েন থেকে কোন সৈন্য আনছিল না। কোন ঐতিহাসিক এ তথ্য লেখেন নাই যে, বাহমান যাবানের সাহায্যার্থে কেন এগিয়ে আসে নাই। ঐতিহাসিক ইয়াকূত লেখেন, বাহমান নিজ বাহিনীতে ফিরে আসছিল। পথিমধ্যে পলায়নরত কতক সৈন্যের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তারা উলাইয়িসের বর্তমান অবস্থা তাকে অবহিত করে। বাহমান সৈন্যদের মাঝে ফিরে যাবার পরিবর্তে সেখানেই যাত্রা বিরতি করে। তার উদ্দেশ্য ছিল, পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। ভর্ৎসনার গ্লানি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। মোটকথা, রণাঙ্গনের ঐ উপর্যপরি ঘোষণার বাস্তবতা যাই হোক না কেন মুসলমানদের মাঝে তা নয়া প্রেরণা সৃষ্টি করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহুও ঘোষণা করেন যে, মাদায়েনের সৈন্য এসে পৌঁছানোর পূর্বেই তোমরা এ বাহিনীর কোমর ভেঙ্গে দাও। কিন্তু ইরানী বাহিনী এবং ইহুদীরা প্রস্তরময় প্রান্তের মত দৃঢ়, অটল অবিচল হয়ে থাকে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রতি রণাঙ্গনে দু’আ করতেন। কিন্তু এই সর্বপ্রথম যুদ্ধ, যেখানে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে হাঁটু ফেলে এবং হাত তুলে দোয়া করেন “হে পরওয়ারদেগার। আমাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং অটুট মনোবল দান করুন যেন আমরা শত্রুদের পিছপা করাতে পারি। আমি অঙ্গিকার করছি যে, আপনার দ্বীনের শত্রুদের রক্তে আমি নদী বইয়ে দিব।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দোয়া শেষে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে হামলা চালাতে থাকেন। ইতোমধ্যে দু’পার্শ্বের সালারদ্বয় দু’দিক থেকে শত্রুদেরকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। হযরত মুসান্নার বাহিনী অব্যাহত গেরিলা হামলা চালিয়েই যেতে থাকে। চতুর্মুখী পরিকল্পিত তীব্র হামলার মুখে শত্রুদের পা টলটলায়মান হয়ে উঠছে। শত্রুসংখ্যা বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে তারাই অধিকহারে আহত ও নিহত হতে থাকে। স্বপক্ষীয় সৈন্যদের এ ব্যাপক হত্যার চিত্র দেখে ইতোপূর্বের বিভিন্ন যুদ্ধে যারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল তারা সাহস হারিয়ে ফেলে এবং রণাঙ্গন থেকে নিজেকে দূরে সরাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের দেখাদেখি অন্য সৈন্যরাও পলায়নের পথ ধরে। শত্রুদের পিছু হটার দৃশ্য দেখে মুসলমান বাহিনী আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর করে। তাদের তলোয়ার এখন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর বিদ্যুৎ বর্ষণ করতে থাকে। এরপর হঠাৎ করে কাফেররা রণে ভঙ্গ দিতে শুরু করে।
***
“পশ্চাদ্ধাবন কর” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই পয়গাম দিয়ে বাহিনীতে দূত পাঠান এবং উচ্চ আওয়াজে এই ঘোষণাও করান যে, তাদেরকে পালিয়ে যেতে দিও না। হত্যাও কর না। জীবিত বন্দী কর।”
এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক ফল এই দেখা দেয় যে, কাফেররা পালানোর পরিবর্তে গণহারে অস্ত্র সমর্পণ করতে শুরু করে। অনেকে পলায়ন করাকেই ভাল মনে করে সটকে পড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত মুসান্নার বাহিনী তাদের ইচ্ছায় বাঁধ সাধে। এ বাহিনী পশ্চাতে ছিল। যারা পালাতে পিছে ভেগে যায় মুসান্নার বাহিনী তাদেরকে ঘেরাও করে করে ফিরিয়ে আনতে থাকে। যুদ্ধ সমাপ্ত। রণাঙ্গণ লাশ এবং অজ্ঞান ও ছটফটরত আহতদের দ্বারা ভরা ছিল। এক কোণে ঐ খানা অবহেলায় পড়েছিল যা শত্রুরা দুপুরে খেতে প্রস্তুত করেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে মুজাহিদরা খানা খেতে বসে যায়। পলায়নপর সৈন্যদের ধরে ধরে আনছিল তারাও পালাক্রমে আহার সেরে নেয়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সময় মুজাহিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন “খানা আল্লাহপাক তোমাদের জন্য প্রস্তুত করিয়েছেন। প্রাণভরে খাও।” মুসলমানরা বিভিন্ন পদের খানা দেখে বিস্মিত হচ্ছিল। তারা ইতোপূর্বে এমন খানা খাওয়া তো দূরে থাক দেখেও নাই। তারা যবের রুটি, উটের দুধ এবং খেজুর খেতে অভ্যস্ত ছিল। আর খাদ্য বলতে তারা এগুলোকেই বুঝত।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা, যে সমস্ত শত্রু জীবিত ধরে আনা হচ্ছিল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে তাদেরকে খুসাইফ নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের মাথা ধড় থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয় যে, মাথা সোজা নদীতে গিয়ে পড়ত। অতঃপর মুণ্ডহীন ধর নদীর কূলে এভাবে নিক্ষেপ করা হত যে, রক্ত যা পড়ার তার সবই নদীতে গিয়ে পড়ত। এভাবে নিহতদের সংখ্যা হাজারেরও বেশী ছিল।
অমুসলিম ঐতিহাসিক এবং বিশেষজ্ঞরা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই নির্দেশকে জুলুমাত্মক বলে অভিহিত করেছে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই নির্দেশের কারণ ছিল স্বীয় অঙ্গীকার পূরণ। তিনি যুদ্ধের এক পর্যায়ে আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন যে, যুদ্ধে বিজয় করায়ত্ত করতে পারলে রক্তের নদী বইয়ে দেবেন।