আব্দুল আসওয়াদ পালিয়ে যাবার পরিবর্তে চিৎকার করে বর্শা চায়। তার বাহিনী হতে এক ব্যক্তি বর্শা হাতে এগিয়ে আসে। সে প্রায় দৌড়ে তার নেতার কাছে আসতে চায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে বাঁধা দিতে ঘোড়ার মুখ ঐ ব্যক্তির দিকে ঘুড়িয়ে নেন। লোকটি পদাতিক ছিল। সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কোপানল থেকে বাঁচতে বর্শা নেতার দিকে ছুঁড়ে দেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বর্শাও আসতে শুরু করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মাথার উপর দিয়েই এ বর্শার গতিপথ ছিল। আব্দুল আসওয়াদ ঠিকমত বর্শা ধরতে দু’হাত প্রসারিত করে রেখেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্শার দৌড় ঠেকাতে না পেরে সর্বশেষ উপায় হিসেবে তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বর্শায় তরবারীর আঘাত হানেন। বর্শার কোন ক্ষতি না হলেও উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়। বর্শার গতি মাঝপথেই থমকে যায়। এবং সে ভূতলে আছড়ে পড়ে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুহূর্তে আব্দুল আসওয়াদের দিকে ঘোড়া ঘুরিয়ে আনেন এবং তার পালানোর পথ রুদ্ধ করেন। তলোয়ারের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার মত শক্তি ও উপায় তার ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিছক কৌতুকের উদ্দেশ্যে তাকে এদিক ওদিক ঘুরাতে থাকেন।
“জনাব খালিদ!” এক সালার জোর আওয়াজে বলেন “তাকে হত্যা করে ফেল। শত্রু এদিকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার গতি তীব্র করে এবং আব্দুল আসওয়াদের নিকট দিয়ে অতিবাহিত হতে তলোয়ার বর্শার মত মারেন। আব্দুল আসওয়াদ ঘোড়ার এক পার্শ্বে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার তার অপর পার্শ্বদেশ ভেদ করে যায়। আব্দুল আসওয়াদ আহত হয়েও নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু সে পালায় না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার পিছন থেকে এসে তার উপর এমন আঘাত করে যে, তার মাথা কেটে এক কাঁধের দিকে চলে যায়। গর্দান সম্পূর্ণ কাটে না।
***
এদিকে যখন আব্দুল আসওয়াদের দেহ ঘোড়ার পিঠ থেকে জমিনে আছড়ে পড়ে ঠিক তখন ফোরাতের দিক হতে অসংখ্য ঘোড়ার খুরধ্বনি ভেসে আসে। ঘোড়া দ্রুত ছুটে আসে। ঘোড়াগুলো যেদিক থেকে আসে সেদিকে ইহুদীদের সৈন্যরা ছিল। অশ্বারোহীদের হাতে বর্শা ছিল। ঘোড়া বিদ্যুতগতিতে ছুটে এসে সোজা ইহুদীদের সারি ভেদ করে যায়। অশ্বারোহীদের হাতের বর্শা এ সময় ইহুদীদের এ ফোঁড় ও ফোঁড় করতে থাকে। ইহুদীদের দৃষ্টি ছিল মুসলমানদের দিকে। তারা পশ্চাৎ আক্রমণ প্রতিহত করার সুযোগ পায় না।
“আমি হারেছার পুত্র মুসান্না!” গেরিলা আক্রমণের হৈ চৈ এর মাঝে একটি কণ্ঠ সকলের কানে আঘাত করে “আমরা তোমাদেরই গোত্রের লোক।… আমি মুসান্না বিন হারেছা।”
এই অশ্বারোহীরা হযরত মুসান্নার অধীনস্থ বাহিনী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুমতিক্রমে তিনি এ বাহিনীকে মূল বাহিনী হতে পৃথক রেখেছিলেন। তারা গেরিলা হামলায় অত্যন্ত দক্ষ ও পটু ছিল। বর্তমান যুদ্ধে কৌশল হিসেবে গেরিলা হামলা চালানোর প্রয়োজনও ছিল খুব। কারণ, এ রণাঙ্গন সর্বোচ্চ দু’ মাইল দীর্ঘ ছিল। ডানে-বামে ছিল দুটি নদী। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এ রণাঙ্গনে বিশেষ কৌশল অবলম্বন তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। এ যুদ্ধে যে সম্পূর্ণ মুখোমুখী হবে তা তিনি স্পষ্ট ভাষায় সালারদের অবগত করিয়েছিলেন, এহেন যুদ্ধে সফলতার একটিই মাত্র পথ; আর তা হলো, শত্রুর উপর ভারী এবং প্রচণ্ড গতিতে হামলা চালানো, আরো ভাল হয় ঢেউয়ের গতিতে হামলা চালাতে পারলে। আর তা এভাবে যে, ছোট ছোট ইউনিট থাকবে। একটি দল আক্রমণ করে ফিরে আসলে আরেকটি দল যাবে। এভাবে নিয়মতান্ত্রিক এবং ধারাবাহিক আক্রমণ চালালে জয় করায়ত্ত হতে সময় লাগবে না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্তমান যুদ্ধে সৈন্যদেরকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দান করেন। সৈন্যরাও দিন-রাত এই প্যাকটিস চালিয়ে আক্রমণের কৌশল রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মল্লযুদ্ধ শেষ হতেই একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি পার্শ্ব বাহিনীকেও যুদ্ধে শামিল করে দেন। প্রথম আক্রমণের নেতৃত্ব হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই দেন। পার্শ্ববাহিনীর সালাররাও নিজ নিজ বাহিনীর সাথে গিয়ে আক্রমণে শরীক হন। ইরানীরা দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে।
তবে মুসলমানরা ইরানীদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায় যে, তারা লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে যে, ইরানী বাহিনী মানসিকভাবেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা ছিল ক্ষুধার্ত। প্লেটে পরিবেশিত ঐ সুস্বাদু ও মজাদার খানা ছেড়ে তাদের তলোয়ার হাতে তুলে নিতে হয়, যা তাদের জন্য বিশেষভাবে রান্না করা হয়েছিল। ক্ষুধার তাড়নায় অনেকে তো মুসলমানদের আক্রমণেরও পরোয়া করেনা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের ব্যাপক জানের কুরবানী দিতে হয়। ইরানী বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুত না হওয়া সত্ত্বেও প্রথম চোঁটেই অনেক মুসলমানকে শহীদ করে দেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পিছে সরে আসেন এবং অন্য গ্রুপ সামনে পাঠান। ইরানীরা সংখ্যাধিক্যে প্রবল ছিল। একজন মুজাহিদের প্রতিপক্ষ ছিল চার-পাঁচ ইরানী এবং ইহুদী। শত্রুকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে মুসান্নার দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী শত্রু শিবিরে ঝড়-তুফান সৃষ্টি করতেই থাকে। হযরত মুসান্না তার বাহিনীকে কয়েকটি ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে দেন। তারা পালাক্রমে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে শত্রুদের পশ্চাতে, পাশে যমদূতের মত হাজির হতে থাকে। এবং চোখের পলকে বর্শার আঘাতে কয়েকজনকে ধরাশায়ী করে তীরবেগে বেরিয়ে যেত। এভাবে শত্রুর দৃষ্টি পশ্চাতেও ফিরে যায়। কিন্তু মুসান্না বাহিনীর নাগাল তারা পায় না। হঠাৎ এক এক প্রান্ত হতে উল্কার বেগে এসে সৈন্যসারি লণ্ডভণ্ড করে দিত। হযরত মুসান্নার এই ঝড়োগতির হামলা থেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ণ ফায়দা উঠাতে থাকেন। পাশ্চাৎ আক্রমণে যখন তারা বিব্রত তখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে মানসিকভাবে আঘাত করতে সম্মুখ হতে চাপ আরো বৃদ্ধি করেন।