***
মুজাহিদ বাহিনী সর্পিল গতিতে এগিয়ে প্রতিপক্ষের সামনে তখন উদয় হয় শত্রুদের দুপুরের আহার প্রস্তুত যখন সদ্য শেষ হয়েছে। সর্বাধিনায়কের নির্দেশে সৈন্যদের জন্য বিশেষ খাদ্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক আল্লামা তবারী, ইবনে হিশাম এবং মুহাম্মদ হুসাইন হায়কাল লেখেন, পারস্য সৈন্যদের ষাড়ের মত প্রতিপালন করা হত। সৈন্যদের স্বাস্থ্যসম্মত এবং পুষ্টিকর খানা খাওয়ানো হত। পারস্যপতিদের বদ্ধমূল বিশ্বাস এই ছিল যে, শক্তিশালী এবং কর্মঠ সেনাবাহিনীই সাম্রাজ্য এবং সিংহাসন নিরাপত্তার রক্ষাকবচ।
ইরান সেনাপতি যাবান অন্য সময়ের চেয়েও এ সময় উত্তম ও মজাদার খানা তৈরি করায় তার অধীনস্থ বাহিনী রীতিমত এ মজাদার খানা পাচ্ছিল। এই খাদ্যের বর্ণনা ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রচুর পশু জবাই করা হয়। গোস্ত ছাড়াও আরো কয়েক আইটেমের খানা ছিল। ঐতিহাসিকগণ লেখেন, যাবান এ উদ্দেশ্যে ভাল ভাল খানার ব্যবস্থা করে যে, তার সৈন্যরা যেন আন্তরিকতার সাথে লড়াই করে এবং এরকম ভাল ভাল খানা খাওয়ার জন্য জীবিত থাকে।
খানা যেহেতু বিশেষ এবং উন্নত ধরনের ছিল তাই তা রাঁধতেও একটু বেশী সময় লেগে যায়। খাদ্য রন্ধন যখন সমাপ্ত তখন ক্ষুধায় সৈন্যরা বড় কাতর হয়ে পড়েছিল। যখন ঘোষণা দেয়া হয় যে খানা প্রস্তুত এবং সবাই যেন নিয়মমত খানা খেতে বসে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তে নিরাপত্তা প্রহরী জলদগম্ভীর স্বরে জানিয়ে দেয় যে, মুসলিম বাহিনী নিকটে এসে পড়েছে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ লক্ষ্যে পূর্ণ সফল হন যে, শত্রু বাহিনী তার আগমনের সংবাদ পূর্ব হতে জানতে পারে না। তিনি শত্রুর মাঝে তাদের অগোচরেই হাজির হন। প্রহরীর মতকে ইরানী ফৌজ এবং ইহুদীদের মাঝে ভীতি ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সালার এবং কমান্ডাররা গলা ফাঁটিয়ে সৈন্যদেরকে যুদ্ধে প্রস্তুতি এবং সারিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিতে থাকে। কিন্তু সৈন্যদের সামনে যে সুঘ্রাণ ও মজাদার খানা ছিল তা ছেড়ে তারা উঠতে রাজি হয় না।
আল্লামা তবারীর বর্ণনা প্রমাণ করে যে, সৈন্যদের থেকে বড় জোরালো এই আওয়াজ ওঠে যে, মুসলমানরা এখনও দূরে আছে। আমরা ক্ষুধায় কাতর।
তাদের আসার পূর্বেই আমরা খানা খেয়ে নিতে পারব। অনেক সৈন্য সালারদের আহ্বান কানে না তুলে খাওয়া শুরু করে দেয়।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। তারা পৌঁছেই যুদ্ধের জন্য উন্মুখ ছিল। ইরানী বাহিনী ও ইহুদীদের মাঝে তারাও ছিল, ইতোপূর্বে যারা মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছিল। তারা নিজেদের ফৌজ মুসলমানদের তলোয়ার এবং বর্শায় নির্মমভাবে নিহত হতে দেখেছিল। এ সমস্ত লোকেরা মুসলমানদের কথা শুনেই ভীত হয়ে পড়ে।
“পানাহার ত্যাগ কর” পূর্ব পরাজিত সৈন্যদের কয়েকজন সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে থাকে “এই মুসলমানদের সুযোগ দিওনা।… তারা নির্বিচারে হত্যা করবে। পালানোর সুযোগ দিবে না…প্রস্তুতি নাও।”
***
আহাররত সৈন্য অগত্যা মাঝপথেই উঠে পড়ে। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। যারা তখনও পানাহার করেনি তারা সালার এবং কমান্ডারদেরও নির্দেশ মানছিল না। ক্ষুধায় তাদের জীবন খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম ছিল। কিন্তু যারা মুসলমানদের রণমূর্তি দেখেছিল, তাদের গণহত্যার বিষয় অবগত ছিল তাদের আতংক এবং উদ্বেগ দেখে সকলেই খানা ছেড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
মুজাহিদ বাহিনী আরো সামনে এগিয়ে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দান করছিলেন।
শত্রুবাহিনী তখনও ঘোড়ায় জ্বিন স্থাপন এবং দেহে বর্ম ধারণে ব্যস্ত ছিল। যাবান আরেকটু সময় হাতে পেতে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী ইহুদী নেতা আব্দুল আসওয়াদ আযালীকে মল্লযুদ্ধ করতে সামনে পাঠায়।
“আমার মোকাবিলা করার হিম্মত কারো আছে কি?” আব্দুল আসওয়াদ ইহুদীদের সারি ডিঙ্গিয়ে সামনে গিয়ে মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলে “আমার তলোয়ারে দ্বিখণ্ডিত হয়ে কারো মৃত্যুর সাধ হয়ে থাকলে সে সামনে আস।”
“আমি ওলীদের পুত্র।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খাঁপ থেকে তরবারী টেনে বের করে উপরে তুলে ধরেন এবং একথা বলতে বলতে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন “আমার তলোয়ার তোর মত ব্যক্তির খুনের পিয়াসী থাকে সদা।… ঘোড়ার পিঠেই থাক এবং নিজের নাম বল।”
“আমি আব্দুল আসওয়াদ আযালী” সে বড় আওয়াজে বলে “আযলান গোত্রের নাম সমুন্নত থাকবে।”
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়া তার পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। একটু আগে গিয়ে আবার পিছে ফিরে আসেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার কোষমুক্ত ছিল। আব্দুল আসওয়াদও মুক্ত তরবারি হাতে ধারণ করেছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছুটন্ত ঘোড়ার উপর থেকেই তার প্রতি আঘাত করেন। কিন্তু আঘাত ব্যর্থ হয়ে যায়। আব্দুল আসওয়াদও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় এবং আরেকবারের মত পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখী হয়। এবার আব্দুল আসওয়াদ আক্রমণ করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার আঘাত এভাবে প্রতিহত করেন যে, আব্দুল আসওয়াদের হাত তলোয়ারের যেখানে ধরা ছিল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তলোয়ার সেখানে গিয়ে লাগে। ঝলকিত তলোয়ারের তীব্র আঘাতে তার বাটে ধরা হাতের দুই আঙ্গুলের মাথা কেটে পড়ে যায়। এবং সেই সাথে তার তলোয়ারও হাত থেকে ছিটকে পড়ে।