“প্রাণে বাঁচতে চাইলে তোমাদের সৈন্যরা কোত্থেকে আসছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তলোয়ারের অগ্রভাগ তার শাহরগে চেপে জিজ্ঞাসা করেন।
সে বাহমান বাহিনীর কমান্ডার ছিল। প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে সে সব কিছু বলে দেয়। সে ভয়ে ভয়ে এটাও জানিয়ে দেয় যে, বাহমান এখন মাদায়েনে। তার স্থলে যাবান সেনাপতি। বনূ বকরের ফৌজের সাথে তারা ঘটনাক্রমে মিলিত হয়েছে। কমান্ডার এ তথ্যও জানায় যে, ইহুদী গোত্রের কিছু নেতা মাদায়েন থেকেও সৈন্য নিয়ে আসবে।
“মদীনার সৈন্যদের অবস্থান তোমরা জান কি?” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করেন।
“তারা অনেক দূরে” কমান্ডার জবাবে বলে “আমরা তাদের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছি।… সম্ভবত দু’দিন পরেই।”
যা কিছু জানার দরকার তা জানা হয়ে গেলে তাকে হত্যা করে তার লাশ সেখানেই মাটিচাপা দেয়া হয়।
***
হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এই অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনাতে থাকেন তখন ইতোমধ্যে সূর্য উঠে গিয়েছিল।
“সংখ্যায় তারা কত হতে পারে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।
“সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা কঠিন জনাব খালিদ?” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমাদের আর তাদের সংখ্যার আনুপাতিক হার তেমনই যেমনটি পূর্বে ছিল। তারা আমাদের থেকে চারগুণ না হলেও তিনগুণ থেকেও অনেক বেশী হবে।”
সময় অপচয় না করে অগোচরেই শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের পথ চলা অব্যাহত রাখেন। তিনি চলতে চলতেই সালারদের সাথে পরামর্শ সেরে নেন, নিজেও চিন্তা করেন এবং নির্দেশ দেন।
আরব মুসলমানদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ইরানীদের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অভিজ্ঞ সেনাপতি আন্দারযগার বলেছিল, এরা বর্বর মরুচারী, মরুভূমিতেই কেবল তারা লড়তে পারে। আন্দারযগার আরো বলেছিল সে তাদেরকে দজলা এবং ফোরাতের ঐ স্থানে লড়াই করতে বাধ্য করবে যে স্থানটি বৃক্ষ, ঝোপ-ঝাড় এবং ঘাসে ভরপুর, এবং কোথাও কোথাও অগভীর জলাভূমিও আছে। কিন্তু আন্দারযগারের সকল স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা ঐ উর্বর এবং শ্যামলিমা সবুজাভ মনোরম স্থানে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেস্তে গিয়েছিল।
“খোদার কসম! তোমরা এখন পানি পথে এবং বন জঙ্গলেও লড়তে পারবে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সালার উদ্দেশে বলেন “বিদেশের মাটিতে তোমরা এত শক্তিধর শত্রুকে তিনবার পরাস্ত করেছ। শত্রুদের লড়াইয়ের কৌশল ভঙ্গি তোমরা দেখেছ। মুসান্না বলেছে, শত্রুরা বর্তমানে যে স্থানে অবস্থান করছে তা দুই দরিয়ার মধ্যবর্তী একটি স্থান ময়দান সমতল, তবে বৃক্ষ এবং সবুজে পরিপূর্ণ। ঘোড়া ছুটানোর সময় এ সমস্ত বৃক্ষ ও তার ঝুলে থাকা ডালপালার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুবা এ সকল ডালে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে।…
ময়দান খুব প্রশস্ত নয়; সংকীর্ণ। শত্রুকে কোনরকম ফাঁদে ফেলা কিংবা নয়া কৌশল অবলম্বনের সুযোগ আমাদের হবে না। এবার মুখোমুখী সংঘর্ষ হবে। ইবনে আমর এবং ইবনে হাতেম পার্শ্ব বাহিনীর সালার থাকবে। তারা নিজ নিজ বাহিনী ব্যবহারের ব্যাপারে স্বাধীন। যখন পরিস্থিতি সামনে আসে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেক সালার তার কমান্ডারদের বলে দেবে, মুখোমুখী সংঘর্ষে সর্বোচ্চ প্রেরণা, ফুরফুরে মন এবং দৃঢ় হিম্মতের প্রয়োজন সর্বাধিক।…
ইবনে হারেছা! এ লড়াইয়ে তুমি আমার অধীনস্থ নও। তোমার সাথে পূর্বেই কথা হয়েছে যে, তুমি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে লড়বে। তবে খেয়াল রাখবে তোমার বাহিনী যেন আমাদের পথে এসে না পড়ে। তোমার বাহিনীকে তুমি যেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছ সেভাবেই তাদের ব্যবহার করবে। তবে তা কোনভাবেই উল্টোপাল্টা এবং অন্ধভাবে নয়। সুশৃঙ্খল এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী।”
“জনাব খালিদ!” মুসান্না বিন হারেছা বলেন, “আল্লাহ আপনাকে রহম করুন আপনি যেমনটি বলেছেন ঠিক তেমনটিই দেখবেন।… আমার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে এখন আমি ফিরে যেতে পারি কি?”
“আমি তোমাকে আল্লাহর ভরসায় ছেড়ে দিচ্ছি ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “যাও, যুদ্ধের ময়দানে দেখা হবে। নতুবা হাশরের ময়দানে।”
হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং চোখের পলকে দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। তিনি আসার সময় ইরানী ঐ কমান্ডারের ঘোড়াও সাথে নিয়ে এসেছিলেন, যাকে তিনি ফিল্মি কায়দায় অপহরণ করে নিয়ে এসে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে হত্যা করেছিলেন। তিনি যাবার বেলা সে ঘোড়াটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদের দিয়ে যান।
সৈন্যসংখ্যার সল্পতা এবং রণসম্ভারের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও মদীনা বাহিনী ঐ ফৌজের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে চলছেন। যাদের সংখ্যা তাদের চেয়ে তিনগুণ থেকেও বেশী। যুদ্ধাস্ত্রও উন্নত। তাদের প্রত্যেক সৈন্যের মাথা শিরস্ত্রাণ এবং চেহারা লৌহ শিকলে ঢাকা। তাদের পা পশুর মোটা এবং শুষ্ক চামড়ার আবরণে আচ্ছাদিত।
॥ পনের ॥
মুজাহিদদের মনে কোন শংকা ছিল না। মাথায় কোন দুশ্চিন্তা কিংবা বদ মতলব ছিল না। তাদের সামনে এক মহান উদ্দেশ্য ছিল। তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল এবং মাজহাবের সম্মান ও মর্যাদা ছিল। বেঁচে থাকার প্রশ্নটি তাদের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা এই মনোভাব পোষণ করত যে, জীবন আল্লাহ প্রদত্ত, তাই তাকে আল্লাহর রাহে কুরবান করতে হবে। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা ইসলাম রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছিল। আল্লাহর রাহে বের হবার পর থেকে তারা বাড়ী-ঘর স্ত্রী, মা বাপ, ভাই বোন এবং পুত্র-কণ্যা হতে কেবল দূরেই সরে যেতে থাকে। তাদের দিন রাত রক্ত-মাটির মাঝেই ব্যয়িত হতে থাকে। জমিন ছিল তাদের বিছানা আর উপরে ছিল আসমান। বাতিলের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেয়া, কুফরের বুক চিরা এবং ইসলামের শত্রুদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদলিত করাই ছিল তাদের ইবাদত। তাদের মুখে জারী থাকত সর্বদা আল্লাহর নাম। আল্লাহর নাম নিয়েই তারা তলোয়ার চালাত। প্রতিপক্ষের তলোয়ারের আঘাতে লুটিয়ে পড়ার সময়ও তাদের মুখে শোনা যেত আল্লাহর নাম। আহত হয়ে তারা আল্লাহকে স্মরণ করত। নিঃসন্দেহে ঈমানের দৃঢ়তা এবং তাজা প্রেরণাই ছিল তাদের অস্ত্র। আর এটাই ছিল তাদের ঢাল।