“আর এটাও খেয়াল রাখবে” যাবান কমান্ডারদের উদ্দেশে বলছিল যে, সামনে হীরা শহর। তোমরা জান যে, হীরা শহরটি আমাদের সাম্রাজ্যের একটি অমূল্য রত্ন– হীরা। মুসলমানরা এ শহর পদানত করলে শুধু সম্রাটের অন্তর ভেঙ্গে যাবে তা নয়; বরং পুরো সেনাবাহিনীর মনোবল ভেস্তে যাবে। হীরা রাজধানী মাদায়েন অপেক্ষাও মূল্যবান এবং গুরত্বপূর্ণ।
সবুজের সমারোহ চিরে এক অশ্বারোহী সাঁতরে আসছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের মাঝভাগে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টি ঐ অশ্বারোহীর প্রতি আটকে যায়। অন্য কাউকে তার কাছে পাঠানোর পরিবর্তে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই তার উদ্দেশে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং তার সাথে গিয়ে মিলিত হন। অশ্বারোহী হযরত মুসান্না বাহিনীর এক সদস্য ছিল।
“ইবনে হারেছার পয়গাম নিয়ে এসেছি আমি” অশ্বারোহী হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বলে “উলাইয়িসের ময়দানে ইরানী ফৌজও এসে গেছে। ইবনে হারেছা খুব সাবধানে সামনে এগুতে বলেছেন।”
“এখনই ফিরে যাও” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অশ্বারোহীকে বলেন “এবং মুসান্নাকে উড়ে আমার কাছে আসতে বলবে।”
হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দূত এমনভাবে গায়েব হয়ে যায় যেন জমিন তাকে গিলে ফেলেছে। তার ঘোড়ার ঘণ্টাধ্বনি কিছুক্ষণ পর্যন্ত শোনা যেতে থাকে।
অতঃপর তা এক সময় বাতাসের শা শা শব্দে মিলিয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজে সৈন্যদের মাঝে ফিরে এসে সালারদের ডেকে পাঠান এবং তাদের বলেন যে, সামনে কেবল বনুবকরই নয়; মাদায়েনের সৈন্যরাও তাদের সাথে এসে মিলিত হয়েছে। তিনি তাদের এ কথাও বলেন যে, মুসান্না বিন হারেছা আসছে। তিনি পূর্বের মত এবারও সালার হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডান এবং বাম বাহিনীতে রাখেন।
একটু পরেই হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু এমনভাবে এসে পৌঁছান যেন তিনি সত্যই উড়ে এসেছেন।
“ইবনে হারেছা?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তুমি নিজ চোখে ইরান বাহিনীকে ইহুদীদের সাথে দেখেছ?”
হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু কেবল দেখেই ছিলেন না, তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কিছু অবগত হয়েছিলেন। তিনি গুপ্তচর আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারাই সর্বপ্রথম তাকে জানায় যে, ইরান বাহিনী ইহুদীদের সাথে এসে মিলিত হয়েছে। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তখনই বিস্তারিত জানার সংকল্প করেন। রাতে তিনি তিন অশ্বারোহী সাথে নিয়ে শত্রুর তাঁবুর নিকটে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন এবং ঘোড়াগুলো একটি বৃক্ষের সাথে বেঁধে রাখেন। সেখান থেকে তারা সন্তর্পনে এবং প্রয়োজন অনুপাতে বিভিন্ন স্থানে ক্রলিং করে করে তাঁবুর নিকটে গিয়ে পৌঁছান। ইরানী মন্ত্রীরা তাঁবুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছিল। তাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান ছিল ১২ হিজরীর সফর মাসের মধ্যবর্তী কোন এক রাতে। আকাশে চাঁদ ছিল পূর্নিমা ভরা। এই রাত একদিকে অনুকূল ছিল আবার অপরদিকে প্রতিকূল হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। তারা যেমন চাদের আলোয় সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল তেমনি প্রহরীরাও তাদের দেখে ফেলার সম্ভাবনা ছিল।
দুই প্রহরী তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। পশ্চাৎ হতে তাদের জাপটে ধরা অতি সহজ ছিল। কিন্তু তাদের পেছনে এক অশ্বারোহী আসছিল। সে জোর গলায় ডেকে প্রহরীদের থামায় এবং তাদের কাছে এসে তাদেরকে অত্যন্ত সতর্ক এবং হুশিয়ার থাকতে বলে। লোকটিকে একজন কমান্ডারের মতই মনে হচ্ছিল।
‘মুসলমানরা রাতে তো আর আক্রমণ করবে না।” এক প্রহরী বলে “তার পরেও আমরা পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক।”
“তোমরা সাধারণ সিপাহী” অশ্বারোহী নির্দেশের ভঙ্গিতে বলে “আমরা কমান্ডাররা যা জানি তা তোমরা জাননা। মুসলমানদের সম্পর্কে বলা যায় না যে, তারা কখন কি করে বসে। তাদেরকে গোবেচারা কোন শত্রু মনে কর না। তোমরা মুসান্না বিন হারেছার নাম শোন নি? তোমাদের জানা নেই যে, সম্রাট মুসান্নার মাথার দাম কত ঘোষণা করে রেখেছে? তাকে মৃত অথবা জীবিত ধরতে পারলে কিংবা যদি কেবল তার কল্লা কেটে উপস্থিত করতে পার তবে ধনৈশর্যে ভরপুর হয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা তাকে ধরতে পারবে না। সে জ্বিন বৈ নয়। কারো দৃষ্টিতে আসে না। সামনে যাও এবং নিজ পয়েন্টে সতর্ক দৃষ্টি রাখ।”
প্রহরী সামনে চলে যায় আর অশ্বারোহী সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তিন জানবাযসহ এক ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। প্রহরীর গমন পথের দিকে না গিয়ে অশ্বারোহী উল্টো পথে সামনে এগুতে থাকে। ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থায় তাকে বন্দী করা ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু এক জানবাযের কানে কানে কিছু বলেন এবং অশ্বারোহীর দিকে তাকান। অশ্বারোহী কমান্ডার তখন ধীর গতিতে চলছিল।
হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু নিকটবর্তী একটি বৃক্ষে চড়ে বসেন। তার এক সাথী জোর আওয়াজে কি যেন বলে। কমান্ডার ঘোড়া দাঁড় করায়। জানবায সাথী তাকে ফিরে আসতে বলে। সে ঐ আহ্বানের জবাবে ফিরে আসতে থাকে। আচমকা হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বৃক্ষ থেকে ঘোড়ার উপর লাফিয়ে পড়েন এবং কমান্ডারকে ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে দেন। মুসান্নার এক সাথী দৌড়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলে আর অপর দু’জন কমান্ডারকে পাঁজাকোলা করে উঠিয়ে নেয়। এবং তার মুখ বেধে দেয়। এরপর দ্রুত কমান্ডার ও তার ঘোড়া সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়। হযরত মুসান্নার জানবাযরা নিজেদের ঘোড়ার বাঁধন খোলে এবং সবাই এত দূরে চলে যায় যে, কেউ চিৎকার দিলেও সে আওয়াজ শত্রুর তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছবে না।