উলাইয়িসে সমবেত ইহুদীদের সংখ্যা মোট কতজনে গিয়ে পৌঁছে ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাদের সর্বাধিনায়ক ছিল আব্দুল আসওয়াদ আযালী। সে ফৌজের সাথে থেকে মাদায়েন থেকে প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করছিল।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অপেক্ষা করার মত সেনাধ্যক্ষ ছিলেন না। তিনি স্বীয় বাহিনীকে সামান্য বিশ্রাম দেয়া জরুরী মনে করেছিলেন। এরপর তাদেরকে উলাইয়িস অভিমুখে মার্চ করার নির্দেশ দেন। গতি স্বাভাবিকতার চেয়ে অনেক দ্রুত ছিল। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে একটু পৃথক হয়ে চলছিলেন।
“আল্লাহর সৈনিকেরা!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু পথিমধ্যে তার বাহিনীর উদ্দেশে বলেন “সামনের লড়াই আমরা এমনভাবে লড়ব, যেভাবে ইরানের সীমান্ত এলাকার সেনাছাউনিতে তোমরা লড়েছিলে।… গেরিলা হামলা।… গুপ্ত আক্রমণ।… তোমরা যাদের সাথে লড়তে যাচ্ছ যারা এ প্রক্রিয়ায় লড়তে অভ্যস্ত নয়। তাদেরকে তোমরা চেন। তারা তোমাদেরই গোত্রের ইহুদী। তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে লড়াই করতে বাধ্য করব। এজন্য আমি তোমাদের মূল বাহিনী হতে পৃথক রেখেছি। তবে মনে রাখবে, আমরা মূল বাহিনীর সেনাপতিরই অধিনস্থ। সাথে সাথে এটাও মনে রাখবে যে, এটা ধর্ম সমুন্নত এবং মাজহাবী চেতনা রক্ষার লড়াই। তোমাদের প্রতিপক্ষ দুই ভ্রান্ত মতবাদী। আল্লাহ্ যে আমাদেরই সাথে তা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রমাণ করতে হবে।… মনে রেখ এই ইহুদী তারাই যারা সর্বক্ষণ আমাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে এবং অগ্নিপূজকদের হাতে আমাদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা তাদের থেকে আজ প্রতিশোধ নিব।”
সৈন্যরা ঈমানী দীপ্ততায় স্লোগান তুলতে থাকে। কিন্তু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের থামিয়ে দেন এবং নীরবে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। তিনি তাদের ভাল করে জানিয়ে দেন যে, আমরা অতি সন্তর্পণে পথ অতিক্রম করব। শত্রুরা আমাদের আগমণের খবর তখন টের পাবে যখন আমাদের তরবারি তাদের হত্যা করতে থাকবে।
***
ইহুদী ফৌজ উলাইয়িসে তাঁবু স্থাপন করে মাদায়েন থেকে প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিল।
“হুশিয়ার! শত্রু আসছে” ইহুদী ফৌজের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সাথীরা একসাথে চিল্লিয়ে ওঠে “খবরদার! সাবধান! প্রস্তুত হও।”
আকস্মিক এ আওয়াজে রীতিমত হুলস্থূল পড়ে যায়। নেতৃপর্যায়ের লোকেরা উঁচু উঁচু বৃক্ষে উঠে খবরের সত্যতা যাচাই করতে চেষ্টা করে। একদল সৈন্যের প্রতি তাদের দৃষ্টি আটকে যায়। তাদের দিকে একটি বাহিনী এগিয়ে আসছিল। নেতারা বৃক্ষে বসেই তীরন্দাজ বাহিনীকে প্রথম সারিতে আসার নির্দেশ দেয়। ইহুদীরা নিয়মিত সৈন্য না হওয়ায় তাদের মাঝে নিয়মতান্ত্রিকতা, সুশৃঙ্খলা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার অভাব ছিল। তারা পরিকল্পিত ও কৌশলী হামলার পরিবর্তে এক স্থানে দাঁড়িয়ে টানা হামলায় অভ্যস্ত ছিল। তারপরেও নেতাদের নির্দেশে ইহুদীরা সারিবদ্ধ হতে থাকে।
আগন্তুক বাহিনী কাছে এসে পড়েছিল প্রায়। সৈন্যরা আরো এগিয়ে এলে নেতাদের মাঝে কিছুটা সংশয়ের উদ্রেক হয়। এক সালার বলে যে, এটা মুসলিম বাহিনী হতে পারে না। কারণ এরা সেদিক থেকে আসছে যেদিকে বাহমানের বাহিনী থাকার কথা ছিল। সেনাপতি দু’অশ্বারোহীকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আগন্তুক বাহিনী সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে বলে।
“এরা শত্রু নয়; বন্ধু” এক অশ্বারোহী দ্রুত ফিরে এসে উঁচু আওয়াজে বলে “আগত বাহিনী পারস্যের ফৌজ।”
“ঈসা মসীহের পূজারীগণ!” বৃক্ষের উপর থেকেই সেনাপতি চিৎকার করে বলে “তোমাদের সাহায্যার্থে মাদায়েন থেকে ফৌঝ এসে গেছে।”
ইহুদীরা আনন্দে স্লোগান তুলতে থাকে এবং এ শ্লোগান চলা অবস্থাতেই যাবানের বাহিনী ইহুদীদের ছাউনীতে এসে প্রবেশ করে। যাবান পুরো বাহিনীর কমান্ড নিজের হাতে নিয়ে নেয়। এবং ইহুদী নেতাদের বলে তারা এখন থেকে তার নির্দেশ এবং নির্দেশনা মোতাবেক চলবে। যাবান ইহুদীদের সাহস বৃদ্ধির জন্য একটি গরম ভাষণ দেয়। তার এ ভাষণের সার-সংক্ষেপ এটাই ছিল যে, এবার তাদেরকে পূর্বের তিন পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ নিতেই হবে।
“…তোমরা তন্বী তরুণীদের সাথে এনেছ” যাবান বলে “তোমরা হেরে গেলে এই কোমল নারীরা মুসলমানদের মালে গণীমত হবে। তাদেরকে তারা বাঁদী বানিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের ইজ্জত-আবরুর দিকে চেয়ে জীবন বাজি রেখে লড়বে।”
সারিবদ্ধ ইহুদীদের মুখে শ্লোগানের খই ফুটছিল। তারা তো প্রথম থেকেই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল এখন সাথে ইরানীদের সুশৃঙ্খল বাহিনী দেখে তাদের সাহস ও মনোবল শত ডিগ্রী বৃদ্ধি পায়।
মদীনা বাহিনীর গতিতে বেশ দ্রুততা ছিল। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তার দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে ডান প্রান্ত দিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন। সেটা শ্যামলিমা এবং সবুজাভ এলাকা ছিল। বৃক্ষের পর বৃক্ষ দাঁড়িয়ে ছিল। বিভিন্ন ঝোঁপ ঝাড় এবং উঁচু উঁচু ঘাসও ছিল প্রচুর। এলাকাটি এত ঘন গাছ-গাছালি ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল যে, কেউ এখানে একটু এগিয়ে গেলেই সে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যেত। এলাকাটি বিনোদন কেন্দ্রও ছিল। ইরানের বড় বড় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা অফিসার এখানে ভ্রমণ এবং শিকার করতে আসত। উলাইয়িসের পরে হীরা নামে একটি শহর ছিল। বাণিজ্য ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ শহরের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী ছিল। এটা ছিল সম্পূর্ণ ইহুদী বসতিপূর্ণ এলাকা। সার্বিক দিক দিয়ে এ শহরটি রুচিশীল, দৃষ্টিনন্দন এবং সমৃদ্ধশালী ছিল।