***
আগুনপূজারী বাহিনীর সেনাপতি বাহমান উরদূশেরের সাথে সাক্ষাৎ করে তার থেকে নতুন নির্দেশ লাভের জন্য মাদায়েন পৌঁছেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক তাকে সম্রাট পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ পৌঁছতে দেয়নি।
“ভাল খবর আনলে ভেতরে যাও” চিকিৎসক বলে “আর ভাল খবর না এনে থাকলে আমি তোমাকে ভিতরে যাবার অনুমতি দিব না।”
“খবর ভাল নয়” বাহমান বলে “আমাদের বাহিনী তৃতীয়বারের মত পরাস্ত হয়েছে। আন্দারযগার তো অন্তর্ধানই হয়ে গেছে।”
“বাহমান!” চিকিৎসক বলে “উরদূশেরের জন্য এর চেয়ে খারাপ খবর আর হতে পারে না। আন্দারযগারকে সম্রাট উরদূশের তাঁর সমরশক্তির সবচেয়ে মজবুত স্তম্ভ মনে করতেন। এই সেনাপতি যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কয়েকবার করে তিনি জিজ্ঞাসা করতে থাকেন যে, আন্দারযগার মুসলমানদেরকে পারস্য সীমানা থেকে তাড়িয়ে ফিরে এসেছে কিনা। এই একটু পূর্বেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন।”
“সম্মানিত ডাক্তার।” বাহমান বলে “একটি বাস্তবতা লুকিয়ে আমরা কোন ভুল তো করছি না। কিসরা একদিন না একদিন অবশ্যই এ তথ্য জেনে যাবেন।”
‘বাহমান!” চিকিৎসক বলে “আমি তোমাকে এই মর্মে সতর্ক করছি যে, তুমি এ খবর সম্রাটকে শুনালে নিজের গলা কেটে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।”
বাহমান সামনে পা বাড়ায় না। সেখান থেকেই ফিরে আসে। তবে সৈন্যদের কাছে ফিরে আসার পরিবর্তে মাদায়েনে কোথাও এই আশায় অবস্থান করতে থাকে যে, সম্রাটের অবস্থা একটু ভাল হলে সে নিজেই সম্রাটকে পরাজয়ের খবর জানাবে এবং তাকে এই প্রতিশ্রুতি দিবে যে, সে গত তিন পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে।
এ দিন কিংবা এর একদিন পর ইহুদিদের এক প্রতিনিধি দল উরদূশেরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক কিংবা রাজ পরিবারের কেউ ইতোপূর্বে জানতে পারে না যে, এই প্রতিনিধি দল কোন্ উদ্দেশ্যে এসেছে। উরদূশের যেহেতু জানত যে, আন্দারযগারের বাহিনীতে ইহুদীরাও যোগ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তাই সে সানন্দে ইহুদী প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়। এই প্রতিনিধি দল সম্রাটকে প্রথম সাক্ষাতে যে খবর শুনায় তাহলো আন্দারযগার পরাজিত হয়েছে।
“আন্দারযগার পরাজিত হতে পারে না।” উরদূশের গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বলে “তোমারা আমাকে এই মিথ্যা খবর শুনাতে এসেছ?… কোথায় আন্দারযগার? তার পরাজিত হওয়ার সংবাদ সঠিক হয়ে থাকলে এটাও নিশ্চিত যে, যেদিন সে মাদায়েনের মাটিতে পা রাখবে সে দিনই তবে তার জীবনের শেষ দিন।”
“আমরা মিথ্যা খবর শুনাতে আসিনি।” প্রতিনিধিদল প্রধান বলে।
“আপনার এই তৃতীয় পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা এসেছি। কিন্তু আপনার সাহায্য ব্যতীত আমরা সফল হতে পারবনা।”
উরদূশের নীরবে ঘরময় পায়চারী করতে থাকে। তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে। ঔষধ তাকে সুস্থ করে তোলার পরিবর্তে দীর্ঘ অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। তৃতীয় পরাজয়ের খবরে তার আশার আলো ধপ করে নিভে যায়। হতাশা আর ব্যর্থতা তাকে চরমভাবে গ্রাস করে ফেলে। সুস্থ হওয়ার যেটুকু ক্ষীণ আশা ছিল তাও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ডাক্তার তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল।
“মহামান্য সম্রাটের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। চিকিৎসক বলে “সম্মানিত মেহমানগণ এখন বিদায় নিলে সম্রাটের জন্য ভাল হত।”
ইহুদী প্রতিনিধিদল প্রস্থানের জন্য আসন ত্যাগ করে। চিকিৎসকের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা ক্ষণকাল দেরী করে না।
“দাঁড়াও!” উরদূশের দুর্বল আওয়াজে বলে “পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করার কথা তোমরা বলছিলে। তা তোমরা কি চাও?”
“কিছু ফৌজ চাচ্ছি মহামান্য সম্রাট। তবে অধিক সংখ্যক অশ্বারোহী হলে ভাল হয়।” প্রতিনিধি প্রধান বলে “আমাদের পুরো গোত্র উলাইয়িসে পৌঁছে গেছে।”
“যা চাবে পাবে” উরদূশের বলে ‘বাহমানের কাছে চলে যাও এবং তার বাহিনীকে সাহায্য হিসেবে নিবে। বাহমান ওলযার ধারে কাছেই কোথাও থাকবে।”
“বাহমান এখন মাদায়েনে জনাব!” কেউ উরদূশেরকে জানায় সে সম্রাটের কাছে এসেছিল। কিন্তু চিকিৎসক তাকে আপনার কাছে আসা ভাল মনে করেনি।”
“তাকে ডাক” উরদূশের নির্দেশ দেয়” আমাকে কোন কিছু লুকিয়ো না। নতুবা সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।”
॥ চৌদ্দ ॥
বাহমান যখন সম্রাটকে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে বলছিল যে, রণাঙ্গন পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগই তার হয়নি তখন ওদিকে উলাইয়িসের চিত্র কিছুটা ভিন্ন ছিল। বাহমান মাদায়েনে আসার সময় যাবানকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপতি নিয়োগ করে এসেছিল এবং তাগিদ দিয়ে বলেছিল, সে যেন তার আসা পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে জড়ানো হতে দূরে থাকে।
যাবান উলাইয়িসের নিকটবর্তী কোথাও অবস্থানরত ছিল। সে এক সূত্রে এই সংবাদ পায় যে, ইহুদীদের একটি ফৌজ উলাইয়িসের আশে-পাশে জমা হচ্ছে। অপর এক সুত্রে সে এ তথ্যও পায় যে, মুসলমান বাহিনী উলাইয়িসের দিকে ক্রমে এগিয়ে আসছে। যাবানের প্রতি নির্দেশ কিছুটা ভিন্ন রকম থাকলেও মুসলমানদের মার্চ করার সংবাদ শুনে সে চুপটি মেরে বসে থাকতে পারে না। নিজ বাহিনীকে মার্চ করার নির্দেশ দিয়ে উলাইয়িসের পথ ধরে।
উলাইয়িস অভিমুখে মুসলমানদের এগিয়ে যাবার খবর যাবানকে বিচলিত করে তুলেছিল। বাহমান সেখানে ছিল না। যাবান ছিল দায়িত্বে। মুসলমানদের ঠেকাতেই এতদূর আসা। তাই কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই সে ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং ইহুদীদের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়।