আব্দুল আসওয়াদ আযলান গোত্রের নেতা ছিল। এটাও বনূ বকরের একটি শাখা। এই হিসেবে আব্দুল আসওয়াদকে আযালীও বলা হত। সে নামকরা ইহুদী বীর ছিল।
“মুসলমানদের হত্যা করা এতই সহজ মনে করেছ?” এক বৃদ্ধ ইহুদী বলে “রণাঙ্গনে তোমরা তাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছ।”
“আমি একটি পরামর্শ দিচ্ছি” ইহুদীদের আরেক নেতা বলে “আমাদের এলাকায় অবস্থানরত মুসলমানদের হত্যা করা হোক। এর পূর্বে তাদের একটি শেষ সুযোগ দিতে হবে ইহুদী ধর্মে ফিরে আসার। এতে রাজি না হলে গোপনে তাদের হত্যা করা হবে।”
“না” আব্দুল আসওয়াদ বলে “আমাদের গোত্রের মুসলমানরা গেরিলা হামলার মাধ্যমে ইরানী বাহিনীর মাঝে যে বিপর্যয় ও ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তার কথা কি তোমরা ভুলে গেছ? তারা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথে ইরানীদের উর্ধ্বতম সামরিক অফিসারদের হত্যা করে। এখানকার একজন মুসলমানকেও যদি তোমরা গোপনে হত্যা কর, তাহলে মুসান্নার গেরিলা গ্রুপ প্রতিশোধ হিসেবে তোমাদের ব্যাপকভাবে হত্যা করবে এবং ঘরে-ঘরে আগুন ধরিয়ে দিবে। তোমাদের সতর্ক ও প্রতিরোধের পূর্বেই তারা নিমিষে সফল অপারেশন চালিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।”
“তাহলে প্রতিশোধ আমরা কিভাবে নিতে পারি?” একজন উদ্বেগের সাথে জানতে চায় “ওলযা রণাঙ্গনে তোমার দু‘পুত্র নিহত হওয়ায় তাদের থেকে কঠিন প্রতিশোধ নেয়া তোমার জন্য অনিবার্য।”
“ইরান সম্রাট আর মুসলমানরা নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায় লড়াইরত” আব্দুল আসওয়াদ বলে “আমাদেরও নিজস্ব ও জাতিগত স্বার্থে যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইরানী ফৌজের সরাসরি সাহায্য ব্যতীত আমাদের পক্ষে তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তোমরা ভাল মনে করলে আমি মাদায়েন গিয়ে সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। আমার বিশ্বাস আমাদের অনুরোধ তিনি ফেলবেন না। সেনাবহর দিয়ে সাহায্য করবেন। তিনি সাহায্য না করলে আমরা নিজেরাই ফৌজ তৈরি করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তুমি ঠিকই বলেছ, মুসলমানদের থেকে দু‘পুত্র হত্যার প্রতিশোধ অবশ্যই আমাকে নিতে হবে। তাদের পরাজিত করে পুত্র হত্যার বদলা আমি নিবই।”
উক্ত বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সক্ষম যত ইহুদী রয়েছে তাদেরকে ফোরাত নদীর উপকূলে উলাইয়িস নামক স্থানে সমবেত করা হোক। সর্বাধিনায়ক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সর্ববাদী নেতা আব্দুল আসওয়াদ আযালীর নাম পাস হয়। বকর বিন ওয়ায়েল এবং তার শাখা গোত্রসমূহের প্রেরণা ভীষণ চাঙ্গা ও উজ্জীবিত ছিল। ক্ষতও ছিল তাজা। নিহতদের পরিবারে মাতম চলছিল। এমতাবস্থায় ফের যুদ্ধের আহ্বানে নওজোয়ান এবং বয়স্ক লোকেরাও যুদ্ধের নেশায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সারা বসতিতে যুদ্ধের হাওয়া বইতে থাকে। প্রতিশোধের প্রশ্নে তারা এত উন্মাদ ও আবেগী হয়ে ওঠে যে, যুবতী নারীরাও পুরুষের বেশে সৈন্যের সারিতে চলে আসে।
***
ইরাকী ইহুদীদের মনোভাব, যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং উলাইয়িস নামক স্থানে ফৌজের আকারে তাদের জমা হওয়ার সংবাদ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অজানা ছিলনা। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যরা অনেক দূরে অবস্থান করলেও শত্রুদের প্রতিটি আচার-আচরণ উঠা-বসা যথাসময়ে রেকর্ড হচ্ছিল। প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে সাথে পেতে থাকেন। তার গোয়েন্দা টিমও চতুর্দিকে ছড়ানো ছিল। ইহুদীদের পাশে আরব মুসলমানরাও অবস্থান করত। মদীনার মুসলমানদের সাথে ছিল তাদের গভীর সম্পর্ক। আন্তরিক টান। উপর্যুপরি মুসলমানদের বিজয় দেখে অগ্নিপূজকদের হাত থেকে নাজাত এবং নির্যাতন থেকে মুক্তির সূর্য চোখের তারায় ঝলমল করতে থাকে। তারা অকৃত্রিমভাবে মুসলমানদের বন্ধু ছিল। তাদের হৃদয়-মন মুসলমানদের সাথেই মিলিত ছিল। ফলে তারা কারো কোন নির্দেশ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুসলমানদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি ও গুপ্তচরবৃত্তি করতে থাকে।
হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদের মানসিক অবস্থা ও মনোবল ছিল অত্যন্ত চাঙ্গা এবং দুরন্ত। এক বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে উপুর্যপরি তিনবার বিরাট জয়লাভ এবং প্রচুর মালে গণীমত অর্জনের দরুণ মুজাহিদ বাহিনীর দৃঢ়তা ও মনোবল ছিল তুঙ্গে। প্রতিটি সৈন্য সাহসে বলীয়ান ছিল। তবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঠিকই জানতেন যে, তার সৈন্যরা দৈহিক দিক দিয়ে দারুণ বিধ্বস্ত। উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না পাওয়ায় দুর্বলতা তাদের গ্রাস করে ফেলছে। ইরান সাম্রাজ্যে পা দেয়ার পর থেকে এখনও তারা বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। সতত মার্চ এবং শত্রুর উদ্দেশে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই কেটেছে তাদের এতদিনের ব্যস্ততম দিনগুলো। এছাড়া তিনটি বিশাল রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা তো ছিলই।
“তাদেরকে পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দাও” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক বৈঠকে কমান্ডারদের উদ্দেশে বলছিলেন “তাদের অস্থি-মজ্জাও চূর্ণ-বিচূর্ণ। যতদিন সম্ভব আমি তাদেরকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে চাই।… শত্রুর উপর নজরদারি করতে যাদেরকে আমরা দজলার উপকূলে রেখে এসেছিলাম তাদেরও এখানে ডেকে পাঠাও …কই, মুসান্না বিন হারেছাকে তো দেখছি না! সে কোথায় গেল?”