“এ চিন্তা আমাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন করে তুলেছে” বাহমান বলে “কিসরা উরদূশের অসুস্থ। আমি জানি, প্রথম দুই পরাজয়ের আঘাত তাকে শয্যাশায়িত করে দিয়েছে। এ মুহুর্তে আরেক পরাজয়ের খবর তাকে চিরদিনের জন্য স্তিমিত করে দেবে। এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, পরাজয়ের সংবাদ বাহককেও সে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিবে।”
“কিন্তু বাহমান!” যাবান বলে “আমাদের লড়াই আর প্রাণ বিসর্জন ব্যক্তি উরদূশের জন্য নয়; যরথুস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা এবং সম্মানের জন্যই আমাদের এই রথযাত্রা এবং আত্মবিসর্জন।”
“তোমার সাথে একটি বিষয়ে পরামর্শ করতে চাই যাবান!” বাহমান বলে “এখন স্পষ্ট যে, আমাদের প্রতি কিসরার যে নির্দেশ ছিল তা এখন অর্থহীন। আমি মাদায়েন যেতে চাই। সেখানে গিয়ে নয়া হুকুম কি তা জেনে আসব। এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সাথে কথা বলতে চাই। তারও এখন এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, যাও এবং মুসলমানদের তুলোধুনা করে আস। তাকে এ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে, সমরশক্তির অধিকারী কেবল আমরাই নই। প্রতিপক্ষও মজবুত। তাদের শক্তিও অগ্রাহ্য করার নয়। আমি বিশ্বাস করি যে, যুদ্ধ দক্ষতা এবং ভরপুর প্রেরণা মুসলমানদের মাঝে যতটুকু আছে তা আমাদের মধ্যে নেই।… যাবান! শক্তির বলে কাউকে পরাজিত করা যায় না।”
“আমি আপনাকে প্রস্তাব করছি” যাবান বলে “সৈন্যদের যাত্রা স্থগিত ঘোষণা করুন এবং এখন আপনি মাদায়েন চলে যান।”
“সৈন্যদের যাত্রা স্থগিত করে দাও” বাহমান নির্দেশের সুরে বলে “তাদের এখানেই তাঁবু স্থাপন করতে বল। আমার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তুমি এ বাহিনীর প্রধান সালার থাকবে।”
“আপনার অনুপস্থিতিতে মুসলমানরা এদিকে এলে কিংবা পরস্পরের সম্মুখীন হলে তখন আমার প্রতি আপনার নির্দেশ কি?” যাবান জিজ্ঞাসা করে “তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হব নাকি আপনার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব?”
“তুমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবে, যেন আমার প্রত্যাবর্তনের আগে কোন সংঘর্ষ না হয়” বাহমান বলে।
ইরানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা স্থগিত ঘোষণা করে সেখানেই তাদের ছাউনী ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। সৈন্যরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। অন্তত কয়েক দিনের জন্য তারা বিশ্রামের সুযোগ পায়। এদিকে বাহমান কয়েকজন অশ্বারোহী বডিগার্ড পরিবেষ্টিত হয়ে মাদায়েনের উদ্দেশে রওয়ানা হয়।
বকর বিন ওয়ায়েলের বসতিতে একসাথে দুই রকম পরিবেশ বিরাজ করছিল। একদিকে ক্রন্দন আর বিলাপের মাতম ছিল আর অপরদিকে আবেগ-উত্তেজনা এবং প্রতিশোধের জযবার উল্লাস ছিল। ইহুদী গোত্রের যে হাজার হাজার লোক হুংকার এবং উল্লাস করতে ইরানী বাহিনীর সাথে মুসলমানদেরকে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়া করতে গিয়েছিল তারা রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে এসেছিল। তাদের কয়েক সাথী নিহত হয়েছিল। কিন্তু আহতও ছিল। তারাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল জীবনটুকু নিয়ে ঘরে ফিরতে। কিন্তু পথিমধ্যেই তারা মারা যায়।
ইহুদীরা মাথা নীচু করে ফিরে আসতে থাকলে বাড়ী-ঘর থেকে নারী, শিশু আর বৃদ্ধরা ছুটে আসে। পরাজিত দলের মাঝে নারীরা তাদের ছেলে, ভাই এবং স্বামীদেরকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। ছেলে পিতাকে আর পিতা ছেলেকে খুঁজে ফিরে। সৈন্যদের পরাজিত হয়ে ফিরে আসাটাই ছিল তাদের জন্য এক চপেটাঘাত। দ্বিতীয় আঘাত পড়ে তাদের অন্তরে যাদের প্রিয়জন রণাঙ্গন হতে ফেরেনা। বসতিতে এমন মহিলাদের বিলাপ আর মাতম চলছিল। তারা উঁচু আওয়াজে কাঁদছিল।
“তবে তোমরা জীবিত ফিরলে কেন?” এক মহিলা পশ্চাদপসারণকারীদের লক্ষ্য করে চিৎকার দিয়ে বলছিল, “তোমাদের ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তোমরা কেন থেকে গেলে না?”
এই আওয়াজ কয়েকটি কণ্ঠের আওয়াজে পরিণত হয়। অতঃপর মহিলাদের এই তীর্যক ভর্ৎসনা ওঠে “তোমরা বনূ বকরের নাম ডুবিয়েছ। তোমরা ঐ সমস্ত মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়েছ। যারা একদিন এ গোত্রেরই লোক ছিল।… যাও এবং প্রতিশোধ নাও।… মুসান্না বিন হারেসার মুণ্ডু কেটে নিয়ে আন। সে একটি গোত্রকে কেটে দুখণ্ড করেছে।”
মুসান্না বিন হারেছা ইহুদী গোত্রেরই একজন সর্দার ছিলেন। তিনি কিছুদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার প্রভাবে এই গোত্রের অনেক লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ফৌজে শামিল হয়ে গিয়েছিল। এভাবে একই গোত্রের লোক পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখী হয়।
আল্লামা তবারী এবং ইবনে কুতাইবা লেখেন, পরাজিত ঈহুদীরা স্ত্রীদের ভর্ৎসনা এবং উত্তেজনায় প্রভাবিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে আবার প্রস্তুত হয়ে যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক লেখেন, ইহুদীদের এ কারণেও রক্ত গরম ও চঞ্চল হয়ে ওঠে যে, সমাজে যাদের কোন মূল্য ও গুরুত্ব ছিল না তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলাম গ্রহণোত্তর ইসলামী ফৌজে শামিল হয়ে তারা এমন শক্তিধর হয়ে ওঠে যে, পারস্যের মত শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে কেবল হুঙ্কার নয়, ইতোমধ্যে তিন তিনবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে।
“পূর্বধর্মে এখন তাদের ফিরিয়ে আনা বড়ই কঠিন” বকর বিন ওয়ায়েলের এক নেতা-আব্দুল আসওয়াদ আযালী বলে “এখন এর একটাই প্রতিষেধক; আর তা হলো নির্বিচারে তাদের হত্যা করা।”