আপনি যা শুনছেন তা যদি এই হয়ে থাকে যে, সেনাপতি আন্দারযগারের সৈন্যরা মদীনার বাহিনীর হাতে নিহত ও পরাজিত হয়েছে, তবে কথাটি এমন সত্য যেমন সত্য আপনি সেনাপতি আর আমি সাধারণ সিপাহী।” প্রবীণ সিপাহী বলে “আকাশেতে ঐ যে সূর্য আর আমাদের এই মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাটাও সঠিক।… মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটা আমার তৃতীয় লড়াই। তিন যুদ্ধেই মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল।… খুব কম।…
যরথুস্ত্রের কসম দিয়ে বলছি! আমার কথার এক বর্ণও যদি মিথ্যা হয় তবে যে আগুনের আমি পূজা করি তা যেন আমাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। নিশ্চয় তাদের মাঝে এমন শক্তি যা চোখে দেখা যায় না। তাদের এই অদৃশ্য শক্তি আমাদের উপর ঐ সময় চড়াও হয় যখন পরাজয় তাদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।”
“আমাকে যুদ্ধ বৃত্তান্ত খুলে বল” সেনাপতি বাহমান বলে “বুঝাও, কিভাবে তোমাদের পরাজয় ঘটল।”
আন্দারযগারের বাহিনী ওলযায় পৌঁছার পরপরই কিভাবে মুসলিম ফৌজের হঠাৎ আগমন হয়, তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে কিভাবে দ্রুত আক্রমণ করে এবং লড়াই শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ সময় মুসলমানরা কোন্ পন্থায় যুদ্ধ করে–বিস্তারিতভাবে সবই সেনাপতি বাহমানকে অবগত করে।
“তাদের যে মূলশক্তির কথা আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি” সিপাহী বলে চলে– “এ যুদ্ধে তা অশ্বারোহী বাহিনী রূপে আসে। এ বাহিনীতে হাজার হাজার ঘোড়া ছিল। আক্রমণের পূর্বে তাদের ঘোড়া ময়দানের কোথাও দেখা যায়নি। আর একসাথে এত হাজার ঘোড়া কোথাও লুকিয়ে রাখাও যায় না। আমাদের পশ্চাৎভাগে দরিয়া ছিল। ঘোড়াগুলো এই দরিয়ার দিক থেকেই আসে। আমরা তাদের সম্পর্কে তখন অবগত হই। যখন তারা পাইকারীভাবে হত্যা এবং ঘোড়া নির্দয়ভাবে পিষতে থাকে। …আলমপনা! এটাই ঐ অদৃশ্য শক্তি যা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং যার কাছে আমরা বরাবর ব্যর্থ হচ্ছি।
***
“তোমাদের মধ্যে ঈমানী শক্তি আছে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় বাহিনীকে সম্বোধন করে বলছিলেন “এটা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা যে, মাত্র ২০ জন হলেও তোমরা ২০০ কাফেরের উপর বিজয়ী হবে।”
ইরানী সৈন্য এবং তাদের সহগামী ইহুদিরা পালিয়ে অনেক দূরে চলে যায়। রণাঙ্গন জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ। একদিকে গণীমতের মাল স্তূপকৃত ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়ার পিঠে বসে ঐ স্তূপের নিকটে সৈন্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতে থাকেন “কুরআনী ঘোষণার বাস্তবায়ন তোমরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছ। ইরানীদের সৈন্যস্রোত দেখে তোমরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলে নয় কি? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ইতিহাস বলবে যে, এটা হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অনুপম সমর কুশলতা ছিল যে, তিনি অশ্বারোহী বাহিনী লুকিয়ে রেখে তাদেরকে ঐ সময় ব্যবহার করেন যখন শত্রুবাহিনী মুসলমানদের হত্যা এবং পিষে ফেলতে প্লাবনের রূপে এসেছিল।… কিন্তু আমি বলব, এটা আমার কোন কৃতিত্ব নয়, বরং ঈমানী শক্তি এবং নৈপূণ্যের ফসল ছিল। যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর বিশ্বাস রাখে আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন।…
“প্রিয় বন্ধুগণ! এখন পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। শুধুই এগিয়ে যেতে হবে। এই ভূখণ্ড ইরানীদের নয়। সকল ভূখণ্ডের মালিক আল্লাহ তায়ালা। জমিনের শেষভাগ পর্যন্ত আল্লাহর বাণী আমাদের পৌঁছাতেই হবে।”
সমবেত সৈন্যরা নারায়-নারায় আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকে। তারা এভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে।
এরপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের মাঝে গণীমতের মাল বণ্টন করে দেন। এবারকার গণীমতের মাল পূর্বের দু‘যুদ্ধের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিয়মানুযায়ী এক পঞ্চমাংশ মাল বাইতুল মালে জমা দিতে মদীনায় পাঠিয়ে দেন।
॥ তের ॥
প্রবীন সিপাহীর বর্ণনায় বাহমান ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আন্দারযগারের সৈন্যরা সত্যই মুসলমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে এবং আন্দারযগার এমনভাবে পালিয়েছে যে, এখন তার কোন পাত্তা নেই। বাহমান যাবান নামী তার এক সালারকে ডেকে পাঠায়।
“আন্দারযগারের পরিণতি নিশ্চয় তুমি শুনেছ” বাহমান বলে “আমাদের প্রতি কিসরার নির্দেশ ছিল, ওলযায় গিয়ে আন্দারযগারের সৈন্যের সাথে মিলিত হওয়া। এ পরিকল্পনা এখন শুধুই অতীত। আমাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তুমি কিছু ভেবেছ?”
“যা কিছুই করি না কেন” যাবান বলে “আমাদের ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না।” “কিন্তু যাবান!” বাহমান বলে “বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরিকল্পিত কোন পদক্ষেপ নেয়াও ঠিক হবে না। তৃতীয়বারের মত মুসলমানরা আমাদের পরাজিত করে ফেলেছে। তুমি এখনো অনুধাবন করনি যে, সে সময় অতীত হয়ে গেছে, যখন আমরা মদীনার বাহিনীকে মরুডাকাত কিংবা বুদ্দু বলে উড়িয়ে দিতাম? এখন আমাদের ভেবে চিন্তেই কদম ফেলতে হবে। প্রতিপক্ষকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসে গেছে।”
“আমাদের পূর্ববর্তী তিন পরাজয়ের কারণ এই একটাই যে, আমাদের সেনাপতিরা প্রতিপক্ষকে কোন গুরুত্ব দেয়নি। এবং মরু লুটেরাদের এক বিক্ষিপ্ত কাফেলা মনে করে তাদের সামনে গিয়েছে” যাবান বলে “প্রত্যেক সেনাপতিই তাদের অমূল্যায়ন এবং তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। প্রথম পরাজয়ের পরেই আমাদের চোখ খুলে যাওয়া দরকার ছিল। শত্রুকে গুরুত্ব দিতে হত। কিন্তু বাস্তবে এমনটি হয়নি।… আপনি নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে।”