মুহূর্তে যুদ্ধের গতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রণাঙ্গনের চিত্র পাল্টে যায়। ইরানীদের বিজয় উল্লাস করুণ আর্তনাদ আর ক্রন্দনে পরিবর্তিত হয়। মুসলিম অশ্বারোহীদের বর্শা তাদের এ ফোঁড় ও ফোঁড় করতে এবং মাটিতে আছড়ে ফেলতে থাকে। অনভিজ্ঞ হাজার হাজার ইহুদীরাই সর্বপ্রথম হুলস্থুল ছড়িয়ে দেয়। পূর্ববর্তী যুদ্ধের পরাজিত সৈন্যরা এই হুলস্থূলকে আরো ব্যাপক করে তোলে। কারণ, তাদের জানা ছিল যে, মুসলমানরা তাদের জীবিত রাখবে না।
রণাঙ্গনে মুসলমানদের নারাধ্বনির গর্জন ওঠে। যুদ্ধের গতি এমনভাবে পাল্টে যায় যে, যরথুস্ত্রের আগুন সহসা নিভে যায়। কোন কোন ঐতিহাসিক ওলযার যুদ্ধকে ‘ওলযার নরক’ বলে অভিহিত করেছেন। আগুন পূজারীদের জন্য এই যুদ্ধ জাহান্নাম থেকে কোন অংশে কম ছিল না। বিশাল বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত ভেড়া বকরীতে পরিণত হয়। তারা পালাতে থাকে আর মুসলমানদের হাতে নিহত হতে থাকে। মুসলমানদের ঘোড়াও সেদিন আজরাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ইরানীদের পদতলে পিষে মারতে থাকে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, ইরানী সৈন্যরা পলায়নের পথ ধরলে আন্দারযগারও পালিয়ে যায়। কিন্তু মাদায়েনের পরিবর্তে সে মরুভূমির দিকে এগিয়ে চলে। কারণ, তার জানা ছিল যে, মাদায়েন ফিরে গেলে উরদূশের তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দিবে। তাই সে মরুভূমির পথে চলতে থাকে এবং ক্রমেই বিস্তীর্ণ মরুবক্ষে হারিয়ে যায়। অতঃপর মরুফাঁদে আটকা পড়ে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করে।
অপর ইরানী বাহিনী সেনাপতি বাহমানের নেতৃত্বে তখনো ওলযায় পৌঁছে ছিল না। এমনি আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অপেক্ষায় মুসলমানদের থাকতে হয়। উভয়টিই ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
***
ইরানীদের প্রখ্যাত সেনাপতি বাহমানকে স্বসৈন্যে ওলযায় পৌঁছানো এবং উরদূশেরের নির্দেশ অনুযায়ী তার ফৌজকে সর্বাধিনায়ক আন্দারযগারের ফৌজের সাথে যোগ করে সম্মিলিতভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর উপর হামলা করার কথা ছিল। কিন্ত বাহমান তখনো ওলযা হতে কয়েক মাইল দূরে ছিল এবং তার এই বিশ্বাস ছিল যে, সে আর আন্দারযগার মিলে মুসলমানদের একেবারে পিষে ফেলবে। তবে আর এত ব্যস্ততা কিসের-এমন একটা ভাব ছিল তার। তার বাহিনী যখন শেষ ছাউনী গুটিয়ে ওলযা অভিমুখে চলতে শুরু করে তখন চার-পাঁচজন বাইরের সৈন্য তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। দু’জন ছিল আহত। আর যারা অক্ষত ছিল তাদের শ্বাস জোরে উঠা-নামা করছিল। তারা এতই ক্লান্ত ছিল যে, পা টেনে টেনে চলছিল। চেহারায় বিনিদ্র রজনী এবং ভীতির ছাঁপ ছিল। এই ছাঁপের মাঝে ধুলোবালির ছিটাও লেপ্টে ছিল।
“তোমরা কারা?” তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় “কোত্থেকে আসছ?”
“সেনাপতি আন্দারযগারের ফৌজের সৈন্য আমরা” তাদের একজন ক্লান্ত জড়িত এবং ভীতিমিশ্রিত কম্পিত কণ্ঠে বলে।
“সবাই মারা পড়েছে” আরেকজন বলে।
“তারা মানুষ নয়?” আরেকটি কাতরকণ্ঠে উচ্চারণ “তোমরা বিশ্বাস করবে না।… আমাদের কথা উড়িয়ে দিবে জানি।”
“এরা মিথ্যাচার করছে এক কমান্ডার খেঁকিয়ে ওঠে “এরা পলায়নপর, সবাইকে ভীত করে নিজেদের সাধু বানাতে চাচ্ছে। তাদেরকে সেনাপতির কাছে নিয়ে চল। আমরা তাদের গর্দান উড়িয়ে দিব। এরা কাপুরুষ।”
তাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে সেনাপতি বাহমানের সামনে উপস্থিত করা হয়। এরই মধ্যে তাদের সম্পর্কে বাহমানকে সংক্ষেপে অবগত করানো হয়।
“তোমরা কোন্ যুদ্ধ লড়ে আসলে?” বাহমান জিজ্ঞাসা করে বলে “লড়াই তো এখনো শুরুই হয়নি। আমার বাহিনী এখনও…।”
“সম্মানিত সেনাপতি!” একজন বলে “যে যুদ্ধে আপনার অংশগ্রহণের কথা ছিল তা সমাপ্ত। সেনাপতি আন্দারযগার নিখোঁজ। আমাদের কুশলী বীর এবং বাহাদুর ‘হাজার ব্যক্তি’ মুসলমানদের সেনাপতির হাতে নিহত হয়েছে।…আমরা যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিলাম। মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী ছিলই না। আমাদের প্রতি নির্দেশ আসে, আরবের এই বুদ্দুদের অধিক হারে হত্যা কর। তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। তাদের দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্লোগান এবং উল্লাস প্রকাশ করতে করতে আমরা সামনে অগ্রসর হতে থাকি। যখন আমরা হামলা করতে করতে তাদের মাঝে ঢুকে পড়ি তখন পশ্চাৎ হতে না জানি কত হাজার অশ্বারোহী আমাদের ঘাড়ে আছড়ে পড়ে। এরপর আমরা বিদিশা হয়ে যাই। আমাদের কারো কোন হুশ থাকে না।”
“শ্রদ্ধাস্পদ সেনাপতি!” আহত এক সিপাহী হাঁফাতে হাঁফাতে বলে “সর্বাগ্রে আমাদের ঝাণ্ডার পতন হয়। কমান্ড দেয়ার কেউ ছিলনা। নিজ নিজ জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় সবাই ব্যস্ত ছিল। হুলস্থুল আর হুটোপুটি চলছিল গণহারে। চারদিকে কেবল আমাদের সৈন্যের লাশ পড়েছিল।”
“আমি কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করব যে, বিশাল এক বাহিনীকে মুষ্টিমেয় কিছু লোক পরাজিত করেছে?” বাহমান সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে।
এ সময়ে তাকে জানানো হয় যে, আরো কয়েকজন সিপাহী এসেছে। তাদেরও বাহমানের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। ১৩/১৪ জনের একটি দল ছিল। তাদের অবস্থা এত বিপর্যস্ত ছিল যে, ৩/৪ জন সিপাহী উপুর হয়ে পড়ার মত ধপ করে বসে পড়ে।
“তোমাকে সবচেয়ে প্রবীন সিপাহী মনে হচ্ছে।” বলিষ্ঠ দেহের আধাবয়সী এক সিপাহীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাহমান বলে “যা শুনলাম তা কতদূর সত্য তুমি আমায় বলতে পার? … তোমরা নিশ্চয় জানো, কাপুরুষতা, পশ্চাদপসারণ এবং মিথ্যা বলার শাস্তি কেমন কঠোর হয়ে থাকে।”