চার বছর আগের ঘটনা। তৃতীয় হিজরী সন মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মদীনা হামলা করতে প্রস্তুত সেনাবাহিনী মক্কায় সমবেত হয়ে এদের সংখ্যা ৩ হাজার। ৭’শত বর্মধারী দু’শ অশ্বারোহী। তিন হাজার উট ছিল যুদ্ধাস্ত্র ও রসদপত্রে বোঝাই। এ বিশালবাহিনী যাত্রার জন্য নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।
গতকালের ঘটনার মত খালিদ-এর মনে পড়ে যে, তিনি এ বিশাল বাহিনী দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। প্রতিশোধের দাবানল নির্বাপিত করার সময় এসে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান ছিল এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। খালিদ ছিলেন এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যের কমান্ডার। তার বোনও এ বাহিনীর সাথে গিয়েছিল। এ ছাড়া আরো চৌদ্দ জন নারী যেতে প্রস্তুত ছিল। এদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাসহ আমর ইবনুল আস এবং আবু জাহেলের পুত্র ইকরামার বিবিরাও ছিল। অবশিষ্ট ছিল শিল্পী-গায়িকা শ্রেণীর। সকলের কণ্ঠে ছিল হৃদয়বিদারক আওয়াজ। তাদের সাথে বাদ্যযন্ত্রও ছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসব উত্তেজনাকর ও আবেগঘন গীত গেয়ে গেয়ে সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখা এবং বদর যুদ্ধে নিহতদের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া।
আফ্রিকার এক হাবশী গোলামের কথা খালিদের বিশেষভাবে স্মরণ হয়। তার নাম ছিল ওয়াহাশী বিন হারব। সে কুরাইশ সর্দার যুবাইর বিন মুতঈমের ক্রীতদাস ছিল। সে দীর্ঘকায়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং খুবই শক্তিশালী ছিল। বর্শা নিক্ষেপে সে ছিল সিদ্ধহস্ত। তার কাছে ছিল আফ্রিকার তৈরী বর্শা। তার আফ্রিকী আরেকটি নাম ছিল। যুদ্ধ প্রিয় দেখে মুনিব যুবাইর তার এই আরবী নাম রেখেছিল– “বিন হারব।”
যুদ্ধ যাত্রার আগে যুবাইর বিন মুতঈম তাকে বলে– “আমি আমার চাচার খুনের প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু আমার সে সুযোগ হয়ত হবে না। বদর রণাঙ্গনে মুহাম্মাদের চাচা হামযা আমার চাচাকে খুন করেছে। এ যুদ্ধে হামযাকে খুন করতে পারলে তুমি আযাদ।
“হামযা আমার নিক্ষিপ্ত বর্শায় নিহত হবে।” মনিবের (আবেগময়) প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ওয়াহশী বলে।
সৈন্যদের সাথে আগত মহিলারা যেখানে ছিল সেখান দিয়ে এই উষ্ট্রারোহী হাবশী গোলাম যাচ্ছিল।
“আবু ওসামা” হঠাৎ করে কোন মহিলা ডাক দেয়।
এটা ওয়াহ্শীর আরেক নাম। ডাক শুনেই সে থমকে দাঁড়ায়। আওয়াজ অনুসরণ করে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পায় যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী তাকে ডাকছে। সে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আবু ওসামা!” হিন্দা বলতে শুরু করে ভয় নেই। আমিই তোমাকে ডেকেছি। আমার হৃদয়ে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তুমি এ আগুন ঠাণ্ডা কর আবু ওসামা।”
“বলুন, আমি কি করতে পারি।” গোলাম আবেগতাড়িত হয়ে বলল সেনাপতির স্ত্রীর হুকুমে নিজে কুরবান হতে আমি প্রস্তুত আছি।”
বদরে আমার পিতাকে খুন করেছে হামযা।” হিন্দা বলে “হামযাকে তুমি ভাল করেই চেন। চেয়ে দেখ, আমার সমস্ত শরীর স্বর্ণালঙ্কারে ঢেকে রয়েছে। হামযাকে খুন করতে পারলে এসব অলঙ্কারের মালিক হবে তুমি।”
ওয়াহশী হিন্দার শরীরস্থ অলঙ্কারের প্রতি একবার লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে মুচকি হেসে দৃঢ়কণ্ঠে বলল অবশ্যই আমি হামযাকে হত্যা করব।”
উহুদ যুদ্ধে সৈন্যদের গমনাগমনের কথা খালিদের মনে পড়ে। যে পথে তিনি যাচ্ছেন সে পথ দিয়েই সৈন্যরা সেদিন মদীনায় পৌঁছেছিল। তিনি সেদিন একটি উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তখন গর্বে তার বুক ফুলে গিয়েছিল। মদীনার মুসলমানদের প্রতিও তার অন্তরে সামান্য দয়ার উদ্রেক হয়েছিল। কিন্তু এই দয়ানুভব সেদিন তাকে ব্যথিত করেনি, বরং আনন্দিতই করেছিল কেননা এটা ছিল রক্তের বৈরীতা। সরাসরি মান-মর্যাদার বিষয়। মুসলমানদের পিষ্ট করাই ছিল তার একমাত্র অঙ্গীকার।
♣♣♣
উহুদ যুদ্ধের বহু দিন পর খালিদ জানতে পারেন যে, মক্কায় সৈন্যদের উপস্থিতি ও যুদ্ধ-প্রস্তুতির সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামপূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, সৈন্যদের যাত্রা, চলার গতি-বিধি, যাত্রাবিরতি এবং মদীনা থেকে তারা কতটুকু দূরত্বে আছে তার সঠিক খবর তিনি যথারীতি রেখেছিলেন। মদীনার উদ্দেশে সৈন্যদের মক্কা ত্যাগের খবর হযরত আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সুকৌশলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করেছিলেন।
মদীনার অনতি দূরে উহুদ পাহাড়ের কাছাকাছি একটি স্থানে কুরাইশ বাহিনী তাঁবু স্থাপন করে। স্থানটি ছিল সবুজ-শ্যামল এবং চমৎকার। পর্যাপ্ত পানিও ছিল। খালিদ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, ইতোমধ্যেই দু মুসলিম গুপ্তচর এসে সমগ্র বাহিনীর উপর হাল্কা জরীপ চালিয়ে মদীনায় গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিস্তারিত খবর অবগত করেছেন।
৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে মার্চ, এদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দেন। ’শাইখাইন’ নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে মুসলিম বাহিনী তাঁবু ফেলেন। নবীজীর সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল একহাজার। একশ সৈন্যের মাথায় শোভা পাচ্ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। মোজাহিদদের নিকট ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। দুটোর একটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে।