পরে ইমাম আবু জাফর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনের শেষ রাতের যে বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন, আমি তা লিপিবদ্ধ করছি। তিনি বলেছেন, আমি সুলতান আইউবীর শিয়রে কুরআন তিলাওয়াত করছিলাম। সে সময় সুলতান কখনো অচেতন হয়ে পড়ছিলেন, কখনো জ্ঞান ফিরে পাচ্ছিলেন। আমি বাইশতম পারার সূরা আল-হজ্ব তিলাওয়াত করছিলাম। যখন পড়লাম আল্লাহই সবসময় ক্ষমতার অধিকারী ও সত্য। তিনিই মৃতকে জীবিত করেন এবং প্রতিটি বস্তুর উপর ক্ষমতা রাখেন। তখন আমি সুলতানের কণ্ঠ থেকে ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি বলছিলেন- এটা সত্য কথা। এটা সত্য কথা। এই ছিলো সুলতান আইউবীর জীবনের শেষ উচ্চারণ। তার অল্পক্ষণ পরেই কানে ফজরের আযান ভেসে আসে। আমি কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ করে দিলাম। আযান শেষ হওয়ামাত্র সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অতি নীরবে ও শান্তিতে ইহজগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যান। ইমাম আবু জাফর আমাকে আরো বলেছেন, যখন আযান শুরু হয়, তখন সুলতান একটি আয়াত পড়ছিলেন- আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। আমরা তাঁরই নিকট সাহয্য প্রার্থনা করি। সে সময়ে তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে ওঠেছিলো। চেহারাটা তার জ্বলজ্বল করছিলো। সেই অবস্থাতেই তিনি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যান।…।
আমি যখন গিয়ে পৌঁছি, ততোক্ষণে সুলতান আইউবী ইহজগত ত্যাগ করে পরজগতে চলে গেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর জাতির গায়ে কোনো কারণে সত্যিকার অর্থে যদি কোনো আঘাত লেগে থাকে, সে ছিলো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর মৃত্যু। দুর্গ, নগরী, জনতা ও তাবৎ পৃথিবীর মুসলমানদের উপর এমন এক কালো মেঘ ছেয়ে যায় যে, একমাত্র আল্লাহই জানতেন, তা কতো গভীর ও গাঢ় ছিলো। সাধারণত মানুষ প্রিয়জনের জন্য জীবন দেয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু কাউকে জীবন দিতে দেখা যায়নি। কিন্তু আমি কসম খেয়ে বলতে পারবো, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনের শেষ রাতে কেউ যদি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো, সুলতানের পরিবর্তে কে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত আছে, তাহলে আমাদের মধ্যে বহু মানুষ নিজেদের জীবন কুরবান করে সুলতানকে বাঁচিয়ে রাখতো।…
সেদিন নগরীতে প্রতিজন মানুষকে অশ্রুসিক্ত দেখা গেছে। জনতা ক্রন্দন ছাড়া সব ভুলে গিয়েছিলো। কোনো কবিকে শোকগাঁথা শোনাবার অনুমতি দেয়া হয়নি। কোনো ইমাম, বিচারপতি কিংবা কোনো আলিম জনতাকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেননি। তাঁরা নিজেরাই ডুকরে কাঁদছিলেন। সুলতান আইউবীর সন্তানরা কাঁদতে ও চীৎকার করতে করতে রাস্তায় নেমে পড়েছিলো। তাদের দেখে মানুষের কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিলো।…
যোহর নামাযের সময় হয়ে গেছে। ততোক্ষণে সুলতানকে গোসল দিয়ে কাফন পরানো হয়ে গেছে। আদালতের এক কর্মকর্তা আদ-দালায়ী সুলতানকে জীবনের শেষ গোসল করান। আমাকে বলা হয়েছিলো। কিন্তু আমার মন অতটা শক্ত ছিলো না। আমি অস্বীকার করি। মাইয়েতকে বাইরে রাখা হয়েছে। যে কাপড়খানা দ্বারা লাশ ঢেকে রাখা হয়েছিলো, সেটি কাজী আল ফজল দিয়েছিলেন। যখন জানাযা জনতার সম্মুখে রাখা হলো, তখন পুরুষদের ক্রন্দনরোল আর মহিলাদের চীৎকারে আকাশের কলিজাও বুঝি ফেঁটে যেতে শুরু করেছিলো।…।
কাজী মুহিউদ্দীন ইবনে যাকী নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। সুলতান আইউবীর নামাযে জানাযায় কতো মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলো, আমি তার সংখ্যা বলতে পারবো না। শুধু এটুকু বলতে পারবো, কান্না আর ফোঁপানির কারণে কেউ দুআ-কালাম পাঠ করতে পারছিলো না। অনেকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চীৎকার করে করে কাঁদছিলো। জামাতের চারদিকে মহিলারা জড়ো হয়ে মাতম করছিলো। নামাযে জানাযার পর লাশের খাঁটিয়া বাগিচার সেই ঘরটিতে রাখা হলো, যে ঘরে সুলতান আইউবী অসুস্থতার দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলেন। আসরের সামান্য আগে মহাকালের মহানায়ক সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দাফন সম্পন্ন করা হয়। জনতা যখন নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছিলো, তখন মনে হয়েছিলো যেনো কতগুলো লাশ হেঁটে যাচ্ছে। আমি সঙ্গীদের নিয়ে কবরে কুরআন পাঠ করতে থাকি।…
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জীবনে দুটি বাসনা ছিলো। ফিলিস্তীনকে খৃস্টানদের থেকে মুক্ত করা এবং হজ্ব করা। তাঁর প্রথম বাসনাটি পূর্ণ হয়েছে। দ্বিতীয়টি অর্থের অভাবে পূরণ হয়নি। তাঁর কাছে হজ্ব করার মতো অর্থ ছিলো না। ব্যক্তিগত পকেট শূন্য ছিলো। নবচন্দ্রের কাঁচি দ্বারা ক্রুসেডীয় ফসল কর্তনকারী মর্দে-মুজাহিদ, মিসর, সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের সম্রাট এমন গরীব ছিলেন যে, অর্থাভাবে হজ্ব করতে পারেননি! তাকে যে কাফন পরানো হয়েছিলো সে আমি, কাজী আল-ফজল ও ইবনে যাকী চাদা করে ক্রয় করেছিলাম।…
আজো ফিলিস্তীন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য তেমনি মাতম করছে, যেমন করেছিলো ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ দামেশকের নারীরা।
[সমাপ্ত]