আমি ও আল-ফজল রাতের প্রথম প্রহর তার কাছে থাকতাম এবং দেখাশোনা করতাম। তিনি কথা বলতে পারতেন না। অবশিষ্ট রাত আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভেতর থেকে কেউ আসলে জিজ্ঞেস করতাম, সুলতানের অবস্থা কেমন। প্রত্যূষে যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতাম, তখন বাইরে জনতার ভিড়। দণ্ডায়মান দেখতে পেতাম। তারা আমাদের নিকট সুলতানের অবস্থা জিজ্ঞেস করার সাহস পেতো না। আমাদের চেহারা দেখেই বুঝে নিতো, সুলতানের অবস্থা ভালো নয়। জনতা চুপচাপ আমাদের প্রতি তাকাতো আর আমরাও তাদের প্রতি এক নজর তাকিয়ে মাথানত করে বেরিয়ে যেতাম।….
দশম দিন ডাক্তারগণ তাকে নাড়ি পরিষ্কার করার ঔষধ সেবন করান। তাতে কিছুটা চৈতন্য ফিরে আসে। তারপর যখন জানতে পারলাম, সুলতান যবের পানি পান করেছেন, তখন আমরা সকলে আনন্দ অনুভব করলাম। সে রাতে তাঁর নিকট যাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকি। জামালুদ্দীন ইকবালের নিকট সুলতানের অবস্থা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি ভেতরে গিয়ে তুরান শাহকে জিজ্ঞেস করে এসে আমাদেরকে জানালেন, সুলতানের উভয় ফুসফুসে বাতাস চলাচল করতে শুরু করেছে। আমরা মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। জামালুদ্দীনকে বললাম, আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসুন অবশিষ্ট শরীরে ঘামের লক্ষণ আছে কিনা। তিনি ভেতরে গিয়ে দেখে ফিরে এসে জানালেন, অনেক ঘাম আসছে। এটি শুভ সংবাদ ছিলো। আমরা নিশ্চিন্ত মনে চলে আসি।…।
পরদিন মঙ্গলবার। সফরের ২৬ তারিখ। সুলতান আইউবীর অসুস্থতার একাদশ দিবস। আমরা তাঁকে দেখতে গেলাম। ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। আমাদেরকে জানানো হলো, ঘাম এতো বেশি ঝরছে যে, বিছানা বেয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ছে। সংবাদটা ভালো ছিলো না। শরীরের রস-আদ্রতা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো। ডাক্তারগণ বিস্ময়ের সঙ্গে জানালেন, শরীর ভেতর থেকে শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সুলতানের দেহে শক্তি বহাল রয়েছে।…
সুলতান আইউবী পুত্র আল-মালিকুল আফজাল দেখলেন, সুলতানের সেরে ওঠার কোনো আশা করা যাচ্ছে না। তিনি তৎক্ষণাৎ আমীর-উজিরদের থেকে আনুগত্যের শপথ নেয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি সকল বিচারপতিকে রেজওয়ান মহলে সমবেত করে বললেন, আপনারা কাগজ প্রস্তুত করে দিন, যাতে সুলতান আইউবী যতোদিন বেঁচে থাকবেন তাঁর আনুগত্যের হলফনামা থাকবে এবং তাঁর ওফাতের পর আল-মালিকুল আফজাল। আল-আফজাল ওজরখাহি করে বললেন, এ হলফনামা কখনো প্রস্তুত করাতাম না। কিন্তু সুলতানের অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে বিধায় কাজটা না করে পারলাম না।..
হলফনামা প্রস্তুত হয়ে গেছে। পরদিন হলফ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আমীর উজিরদের তলব করা হলো। সর্বপ্রথম দামেশকের গবর্নর সাদুদ্দীন মাসউদ শপথ করেন। তারপর সাহয়ুনের গবর্নর নাসরুদ্দীন আসলেন। তিনি এই শর্তে হলফ করেন যে, তিনি যে দুর্গের গবর্নর, সুলতান আইউবীর মৃত্যুর পর সেটি তার ব্যক্তি মালিকানা, বলে গণ্য হবে। সকল আমীর-উজির ও গবর্নর আনুগত্যের শপথ করলেন। দু-তিনজন হলফ করার আগে শর্ত আদায় করে নেন। হলফনামার ভাষ্য ছিলো নিম্নরূপ–
এই মুহূর্ত থেকে বৃহত্তর ঐক্যের খাতিরে আমি আল-মালিকুন নার (সালাহুদ্দীন আইউবী)-এর অনুগত থাকবো, যতোদিন তিনি জীবিত থাকেন। তাঁর শাসন ক্ষমতাকে অটুট রাখার লক্ষ্যে অক্লান্ত ও অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাবো। তার খাতিরে নিজের জীবন, সম্পদ, তরবারী, সৈন্য এবং প্রজাদের ওয়াফ করে দেবো। আমি তাঁর প্রত্যেকটি আদেশ-নিষেধ মান্য করবো এবং তাঁর প্রতিটি আকাঙ্খা পূর্ণ করবো। আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, সুলতান আইউবীর পর এই আনুগত্য তাঁর পুত্র আল-মালিকুল আফজালের জন্য ওয়াফ করে দেবো এবং তারপরে আল-মালিকুল আফজালের পুত্রদের জন্য। আমি আল্লাহকে হাজির-নাজির জ্ঞান করে প্রতিটি আদেশ-নিষেধ পালন করবে। তার জন্য নিজের জান-মাল, তরবারী ও সৈন্যদের ওয়াকফ করে রাখবো। এই আনুগত্যের শপথে আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি।…
হরফনামার অপর অংশ ছিলো–
আমি যদি আমার এই হলফের বিরুদ্ধাচরণ করি, তাহলে এই শপথ ভঙ্গের দায়ে আমার স্ত্রী-স্ত্রীগণ তালাক হয়ে যাবে, আমি সকল ব্যক্তিগত ও সরকারি চাকরদের থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং আমি খালি পায়ে পব্রজে হজ্ব করতে বাধ্য থাকবো।….
৫৮৯ হিজরীর ২৬ সফর মোতাবেক ১১৯৩ খৃস্টাব্দের ৩ মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অসুখের একাদশ দিবস। তাঁর শরীরের শক্তি-সামর্থ সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর বেঁচে থাকার আশা নেই। রাতে এমন এক সময়ে আমার ও কাজী আল-ফজল ইবনে যকির ডাক পড়ে, যে সময়ে পূর্বে কখনো ডাকা হয়নি। ইবনে যকির পুরো নাম আবুল মাআলী মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন। হযরত ওসমান (রা.)-এর বংশের লোক। আইন ও বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করার পর সুলতান আইউবী মসজিদ আকসায় প্রথম জুমার খুতবা দেয়ার জন্য তাকেই মনোনীত করেছিলেন। পরে তাঁকে দামেশকের বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়েছিলো।…
আমরা গেলে আল-মালিকুল আফজাল বললেন, আপনারা তিনজন বাকি রাত সুলতানের সঙ্গে থাকুন। তিনি শোকাহত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কাজী আল-ফজল আপত্তি তুলে বললেন, রাতভর মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে সুলতানের স্বাস্থ্যের সংবাদ শোনার অপেক্ষা করে। আমরা যদি সারারাত ভেতরে থাকি, তাহলে তারা অন্য কিছু ভেবে বসবে এবং নগরীতে ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে। আল-আফজাল যুক্তিটা মেনে নেন। তিনি বললেন, ঠিক আছে। আপনারা চলে যান। তিনি আমাদের পরিবর্তে ইমাম আবু জাফরকে ডেকে পাঠান। ইমাম আসলে আল-ফজল বললেন, আপনি সুলতানের কাছে থাকুন। আল্লাহ না করুন যদি রাতে মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়, তাহলে তার শিয়রে বসে কুরআন তিলাওয়াত করুন। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি।…