আহারের পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন- হাজীরা ফিরে এসেছে কি? আমি বললাম, রাস্তায় অনেক কাদা। চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। আশা করি, কাল নাগাদ এসে পৌঁছবে। সুলতান বললেন, আমরা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে যাবো। বলেই তিনি একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন, হাজ্বীরা আসছে। রাস্তায় কাদা ও পানি আছে। এখনই লোক পাঠাও, পথের কাদা-পানি পরিষ্কার করাও। আমি তার থেকে অনুমতি নিয়ে চলে আসি। আমি দেখলাম, সুলতানের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কর্মতৎপরতায় বেশ ভাটা পড়ে গেছে।…
পরদিন ঘোড়ায় আরোহণ করে তিনি হাজ্বীদের অভ্যর্থনা জানাতে বেরিয়ে পড়েন। আমিও ঘোড়ায় চড়ে তার পিছু নেই। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল সঙ্গ নেয়। মানুষের মাঝে দাবানলের ন্যায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, সুলতান বাইরে এসেছেন। জনতা কাজ-কর্ম ত্যাগ করে ছুটে আসে। তারা তাদের বিজয়ী সুলতানকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য উগ্রীব হয়ে ওঠে। সুলতান তার এই পাগলপারা ভক্তদের মাঝে হারিয়ে যান। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল সন্ত্রস্ত কণ্ঠে আমাকে বললো, সুলতান তো বর্ম পরিধান করে বের হননি! আমার ভয় লাগছে। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে কততক্ষণ! সে সময় সুলতানের সঙ্গে দেহরক্ষী ছিলো না। আমি ভিড় ঠেলে সুলতানের নিকট গিয়ে বললাম, হযরত! আপনি বিশেষ পোশাক পরে বের হননি। শুনে তিনি এমনভাবে চমকে ওঠেন, যেনো তাঁকে হঠাৎ ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি বললেন, পোশাকটা এখানেই নিয়ে আসো। কিন্তু পোশাক এনে দেয়ার মতো সেখানে কেউ ছিলো না। আমার বেশ ভয় লাগছিলো।…
আমার মনে হতে লাগলো, যেনো কোনো অঘটন ঘটে যাবে। আমি তাকে বললাম, আমি এখানকার পথঘাট চিনি না। অন্য কোনো রাস্তা আছে কি, যেখানে লোকজন কম হবে এবং আপনি ফিরে যেতে পারবেন? তিনি বললেন, একটি রাস্তা আছে। তিনি ঘোড়ার মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দেন। জনতার ভিড় ছিলো গণনাতীত। সুলতান আইউবী ঘোড়াটা বাগ-বাগিচার মধ্যকার এক রাস্তায় তুলে দেন। আমি ও আল-মালিকুল আফজাল তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমি তাঁর জীবনেরও আশংকা অনুভব করছিলাম এবং স্বাস্থ্যেরও। আমরা আল মাইবানার কূপ হয়ে দুর্গে এসে প্রবেশ করি।…
শুক্রবার সন্ধ্যায় সুলতান আইউবী অস্বাভাবিক দুর্বলতা অনুভব করেন। মধ্যরাতের সামান্য আগে তাঁর গায়ে জ্বর আসে- চোরা জ্বর। শরীরের ভেতরে বেশি ছিলো, বাইরে কম অনুভব হচ্ছিলো। সকাল নাগাদ তিনি বেশ কাহিল হয়ে পড়েন। কিন্তু গায়ে হাত দিলে তেমন গরম অনুভব হচ্ছিলো না। আমি তাকে দেখতে গেলাম। পুত্র আল-মালিকুল আফজাল শিয়রে বসা ছিলো। সুলতান বললেন, রাত অনেক কষ্টে কাটিয়েছি। তিনি এদিক-ওদিকের কথা শুরু করে দেন। আমরা গল্প-গুজবে তাকে সঙ্গ দেই। তাতে তার মন-মেজাজে প্রফুল্লতা ফিরে আসে। দুপুর নাগাদ বেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমরা বিদায় নিতে উদ্যত হলে তিনি বললেন, বসুন, খানা খেয়ে যাবেন। আমার সঙ্গে কাজী আল-ফজলও ছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কারো কাছে আহারে অভ্যস্ত ছিলেন না। তাই ওজরখাহি করে চলে যান। আমি খাওয়ার রুমে চলে যাই। সুলতানের সঙ্গ ছেড়ে উঠতে মন সরছিলো না। অন্তরটা তার নিকট রেখেই খাওয়ার রুমে চলে যাই। দস্তরখান বিছানো হয়েছে। অনেক লোক বসে আছে। আল-মালিকুল আফজাল পিতার জায়গায় বসা। আফজাল সুলতান আইউবীর পুত্র বটে, কিন্তু সুলতানের স্থানে তাকে উপবিষ্ট দেখে বেশ কষ্ট লাগলো। অন্য যারা বসা ছিলেন, তাদেরও প্রতিক্রিয়া আমারই ন্যায় ছিলো। অনেকের চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসে।…
সেদিনের পর থেকে সুলতান আইউবীর স্বাস্থ্য খারাপই হতে থাকে। আমি ও কাজী আল-ফজল প্রত্যহ কয়েকবার তাকে দেখতে যেতাম। একটু সুস্থতাবোধ করলেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। অন্য সময় চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতেন। আমরা তাঁর প্রতি তাকিয়ে থাকতাম। তাঁর জীবনের জন্য সবচে বড় আশংকাটা ছিলো, তার ব্যক্তিগত ডাক্তার অনুপস্থিত ছিলেন। চারজন ডাক্তার মিলে তার চিকিৎসা করছিলেন। কিন্তু রোগ দিন দিন বেড়েই চলছিলো।…
অসুখের চতুর্থ দিন সুলতানের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ জোড়া বেকার হয়ে যায়। দেহের ভেতরে রস শুকিয়ে যেতে শুরু করে। সুলতান আইউবী দুর্বলতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হন। ষষ্ঠ দিন আমরা তাকে ধরে তুলে বসাই। তাঁকে একটি ওষুধ সেবন করানো হলো, যার পর গরম পানি পান করার প্রয়োজন ছিলো। পানি আনা হলো। পানিটা হাল্কা গরম হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু গ্লাসটা মুখের সঙ্গে লাগিয়ে সুলতান বললেন, পানি অনেক গরম। তিনি পানি পান করলেন না। পানি ঠাণ্ডা করে আনা হলো। সুলতান বললেন, এবার একেবারে ঠাণ্ডা। সুলতান সামান্যতম বিরক্তি প্রকাশ করলেন না। শুধু হতাশা প্রকাশার্থে বললেন- ইয়া আল্লাহ! কেউ কি নেই, যে আমাকে হাল্কা গরম পানি এনে দিতে পারবে?…
আমার ও আল-ফজলের চোখে অশ্রু নেমে আসে। আমরা অন্য এক কক্ষে চলে আসি। কাজী আল-ফজল বললেন, জাতি কতো মহান এক ব্যক্তিত্ব থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। তার স্থলে অন্য কেউ হলে পানির গ্লাসটা মাথায় ছুঁড়ে মারতেন।…
সপ্তম ও অষ্টম দিন সুলতান আইউবীর অবস্থা এতো খারাপ হয়ে যায় যে, তাঁর জ্ঞান হারিয়ে যেতে শুরু করে। নবম দিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পানিও পান করতে পারলেন না। নগরীতে খবর ছড়িয়ে পড়ে, সুলতান আইউবীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছে। সমগ্র নগরীতে মৃত্যুর বেদনা ছেয়ে যায়। সব জায়গায় এবং সকলের মুখে তার সুস্থতার জন্য দুআ চলছে। ব্যবসায়ী ও সওদাগররা এমন ভয় পেয়ে যায় যে, তারা বাজার থেকে পণ্য তুলে নিতে শুরু করে। প্রতিজন মানুষ কিরূপ হতাশ ও অস্থির হয়ে ওঠেছিলো, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো ছিলো না।…