রিচার্ডের রওনার পর সুলতান আইউবী ঘোষণা দেন, বাহিনীর যেসব সৈন্য হজ্বে যেতে চাও নাম লেখাও। তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হজে পাঠানো হবে। তালিকা প্রস্তুত হয়ে যায়। আগ্রহী সকলকে হজ্বের উদ্দেশ্যে রওনা করা হয়। স্বয়ং সুলতান আইউবীর নিজের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খ ছিলো হজ্ব করবেন। কিন্তু জিহাদ তাকে সুযোগ দেয়নি। আর যখন অবসর পেলেন, তখন তার নিকট হজ্বে যাওয়ার অর্থ ছিলো না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিতে বলা হলো। তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, এই অর্থ আমার নয়। সুলতান আইউবী নিজেকে হজ্ব থেকে বঞ্চিত করলেন। রাজকোষ থেকে কোন অর্থ নিলেন না। মিসরী কাহিনীকার মুহাম্মদ ফরিদ আৰু হাদীদ লিখেছেন, মৃত্যুর সময় সুলতান আইউবীর সর্বমোট সম্পদ ৪৭ দেরহাম রুপা এবং এক টুকরো সোনা ছিলো। নিজস্ব কোনো বাসগৃহ ছিলো না।
***:
সুলতান আইউবী ১১৯২ সালের ৪ নবেম্বর বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দামেশক গিয়ে পৌঁছেন। তার চার মাস পর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এই বীর মুজাহিদ মহাকালের মহানায়ক ইহলোক ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। দামেশক পৌঁছার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর স্বচক্ষে দেখা পরিস্থিতি কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এভাবে বর্ণনা করেছেন–
… তার শিশু সন্তানরা দামেশকে ছিলো। একটানা পরিশ্রম ও সর্বশেষ অসুস্থতার পর বিশ্রামের জন্য তিনি এ নগরীকেই পছন্দ করেন। সন্তানরা তাকে দেখে বেশ আনন্দিত হয়েছিলো। দামেক ও আশপাশের মানুষ তাদের বিজয়ী সুলতানকে দেখার জন্য দলে দলে আসতে শুরু করে। স্বজাতির এই ভক্তি ও আন্তরিকতা দেখে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী পরদিনই জনসভার আয়োজন করেন, যেখানে সুলতানের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করার এবং কারো কোনো অভিযোগ কিংবা দাবি-দাওয়া থাকলে পেশ করার অনুমতি প্রদান করেন। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, ধনী-গরীব, শাসক-জনতা সকলে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এসে ভিড় জমায়। কবিরা সুলতানের শানে কবিতা আবৃত্তি করেন।
বিরামহীন যুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের নানাবিধ ব্যস্ততা সুলতান আইউবীকে না দিনে কখনো বিশ্রাম নিতে দিয়েছে, না রাতে একটু শান্তির ঘুম ঘুমাতে দিয়েছে। তিনি শারীরিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলেন এবং মানসিকভাবেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই ক্লান্ত শরীর-মনকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য তিনি দামেশকে হরিণ শিকার করাকে ব্যস্ততা বানিয়ে নেন। তিনি ভাই ও সন্তানদের সঙ্গে শিকার খেলায় মেতে ওঠেন। তার ইচ্ছা ছিলো, দিন কয়েক বিশ্রাম করে মিসর চলে যাবেন। কিন্তু দামেশকের রাষ্ট্রীয় কাজ তাকে আটকে রাখে।…
আমি সেসময় উজিরের দায়িত্ব নিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করছিলাম। একদিন দামেশক থেকে সুলতান আইউবীর একখানা পত্র এসে পৌঁছে। তিনি আমাকে দামেশক যেতে বলেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কিন্তু লাগাতার মুষলধারী বৃষ্টির কারণে পথঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো। ঊনিশ দিন পর্যন্ত আমি বেরই হতে পারলাম না। অবশেষে ২৩ মহররম শুক্রবার রওনা হয়ে ১২ সফর মঙ্গলবার দামেশক গিয়ে পৌঁছি। সে সময় বৈঠকখানায় আমীর ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ সুলতানের অপেক্ষা করছিলেন। সুলতানকে আমার আগমনের সংবাদ জানালো হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে তার খাস কামরায় যেতে বললেন। আমি তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দুবাহু প্রসারিত করে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর চেহারায় এমন প্রশান্তি ও স্থিরতা আমি অতীতে কখনো দেখিনি। তার দুচোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসে।
পরদিন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর খাস কামরায় গিয়ে প্রবেশ করলে জিজ্ঞেস করেন, বৈঠকখানায় কারা আছে? আমি বললাম, আপনার পুত্র আল-মালিকুল আফজাল, কয়েকজন আমীর এবং আরো অনেক লোক। তারা আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছেন। তিনি জামালুদ্দীন ইকবালকে বললেন, তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে ওজরখাহি করে বলে দাও, আজ আমি কাউকে সাক্ষাৎ দিতে পারবো না। তিনি আমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলেন। আমি চলে যাই।…।
পরদিন তিনি অতি প্রত্যূষে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি যখন গেলাম, তখন তিনি বাগানে সন্তানদের নিয়ে খেলা করছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, বৈঠকখানায় কোনো সাক্ষাৎ প্রার্থী আছে কি? তাকে জানানো হলো, ফিরিঙ্গিদের দূত এসে বসে আছে। সুলতান বললেন, তাদেরকে এখানেই পাঠিয়ে দাও। সন্তানরা সেখান থেকে চলে যায়। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান আমীর আবু বকর সুলতান যাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন- সেখানে থেকে যায়। ফিরিঙ্গিরা এলে শিশুটি লোকগুলোর দাড়িবিহীন চেহারা এবং তাদের পোশাক দেখে ভয়ে কাঁদতে শুরু করে। শিশুটি এর আগে কখনো দাড়িবিহীন পুরুষ দেখেনি। সুলতান আইউবী বললেন, আমার পুত্র আপনাদের দাড়িবিহীন চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কিন্তু এই সমস্যার মোকাবেলায় সুলতান শিশুটিকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার পরিবর্তে দূতদের বললেন, আজ আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবো না। তিনি তাদেরকে আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকেই বিদায় করে দেন।…
তাদের চলে যাওয়ার পর তিনি বললেন, খাবার যা আছে নিয়ে আসো। তাঁর সম্মুখে হাল্কা কিছু খাবার এনে হাজির করা হলো। তাতে ক্ষিরও ছিলো। তিনি সামান্যই খেলেন। আমি অনুভব করলাম, যেনো তার ক্ষুধা মরে গেছে। তার সঙ্গে আমিও খেলাম। তিনি বললেন, মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ-কথাবার্তা কম করছি। ক্ষুধামান্দ্য এবং দুর্বলতা অনুভব করছি।…