তোমার ইসলামের সঙ্গে বেশি ভালোবাসা, নাকি রিচার্ডের বোনের সঙ্গে?
উভয়ের সঙ্গে।
তাহলে তাকে তোমার ধর্মে দিক্ষিত করো এবং বিয়ে করে নাও- সুলতান আইউবী বললেন- আমি অনুমতি দিচ্ছি।
আমি আপনার নিকট বিয়ের অনুমতি নিতে আসিনি- আল-আদিল বললেন- আমি আপনাকে বলতে এসেছি, রিচার্ডের ন্যায় একজন সাহসী এবং যুদ্ধবাজ সম্রাটও এতো নীচে নামতে পারলেন! আমি স্বীকার করছি, তার বোনটাকে আমার ভালো লাগছে। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমি আপন ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।
আর সেও নিজ ধর্মের সঙ্গে গাদ্দারী করবে না।
জাহান্নামে যাক- আল-আদিল বললেন- এই অস্ত্র দ্বারা রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাস নিতে পারবে না।
সুলতান আইউবীর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ রিচার্ডের এই হীন আচরণটাকে লুকাবার চেষ্টা করেছেন। তারা লিখেছেন, রিচার্ড খৃস্টধর্ম গ্রহণের শর্তে আল-আদিলকে তার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রিচার্ডের বোন আল-আদিলকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে গিয়ে ছাউনি স্থাপন করেন। এখানে আক্রা অপেক্ষা বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়ার আশংকা ছিলো। তিনি পূর্বে যেসব শর্ত আরোপ করে সন্ধির প্রস্তাব করেছিলেন, এখানে এসেও সুলতান আইউবীকে সেসব শর্ত আরোপ করতে শুরু করেন। বারংবার এক কথা কারুরই ভালো লাগে না। একবার সুলতান আইউবী বিরক্ত হয়ে রিচার্ডের দূতকে অপমান করে তাঁবু থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
এ সময়ে সুলতান আইউবী সংবাদ পান, রিচার্ডের অসুখ হয়েছে। এমন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে, বাঁচবার আশা নেই। সুলতান রাতে তাঁবু থেকে বের হয়ে রিচার্ডের তাবু অভিমুখে রওনা হন। কোথায় যাচ্ছেন আল আদিল ছাড়া কাউকে বলেননি। আল-আদিল বললেন, অমুক স্থানে রিচার্ডের বোন আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা। আপনি তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
জুয়ানা যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনে দৌড়ে এসে বলে ওঠে- তুমি এসে পড়েছে আল-আদিল? সুলতান আইউবী ঘোড়া থেকে নেমে জুয়ানাকে ঘোড়ায় বসিয়ে চুপি চুপি রিচার্ডের তাবুর দিকে রওনা দেন। জুয়ানা সুলতানকে কিছু বলছিলো। সুলতান আইউবী বললেন- তোমার ভাষা আমার ভাই বোঝে- আমি বুঝি না। জুয়ানা কী বললো সুলতান বুঝতে পারেননি।
সুলতান আইউবী রিচার্ডের তাবুতে প্রবেশ করেন। রিচার্ড সত্যিই গুরুতর অসুস্থ। সুলতান আইউবীর সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি দোভাষী ডাকেন। সুলতান আইউবী প্রথম কথাটা বললেন- বোনকে সামলাও। আমার ভাই আপন ধর্ম ত্যাগ করবে না। বলো তোমার কষ্টটা কী? আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। এমন ভেবো না, তোমাকে মুমূর্ষ দেখে গিয়ে আমি আক্রমণ করবো। সুস্থ হও, যুদ্ধ পরে করবো।
রিচার্ড বিস্ময়াভিভূত হয়ে ওঠে বসেন এবং সম্ভবত অলক্ষ্যেই বলে ওঠেন তুমি মহান সালাহুদ্দীন আইউবী! তুমিই সত্যিকার যোদ্ধা!
রিচার্ড সুলতান আইউবীকে কষ্টের কথা জানান। সুলতান বললেন আমাদের অঞ্চলে রোগাক্রান্ত মানুষকে আমাদের ডাক্তারই সুস্থ করে তুলতে পারে। ইংল্যান্ডের বাহিনী যেমন এখানে এসে অথর্ব হয়ে যায়, তেমনি তোমাদের ডাক্তারও এখানে এসে আনাড়ি হয়ে যায়। আমি ডাক্তার পাঠাবো।
সালাহুদ্দীন। আমরা আর কতোকাল একে অপরের রক্ত ঝরাতে থাকবো? রিচার্ড বললেন- আসো, সন্ধি ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে ফেলি।
কিন্তু তুমি বন্ধুত্বের যে মূল্য দাবি করছে, আমি তা পরিশোধ করতে পারবো না- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা খুন-খারাবিকে ভয় করছে। আমার জাতি বাইতুল মুকাদ্দাসের খাতিরে নিজেদের প্রতি ফোঁটা রক্ত কুরবান করে দেবে।
ফিরে এসে সুলতান আইউবী তার প্রাইভেট ডাক্তারকে রিচার্ডের চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন। তাঁর সেরে ওঠতে বহুদিন কেটে গেছে। সুলতান আইউবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আক্রমণের পরিবর্তে রিচার্ডের পক্ষ থেকে সন্ধির নতুন নতুন শর্ত আসে। রিচার্ড বাইতুল মুকাদ্দাস থেক হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। শুধু এতোটুকু সুবিধা প্রার্থনা করেন যে, খৃস্টান পর্যটকদের বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হক এবং উপকূলীয় কিছু অঞ্চল খৃস্টানদের দিয়ে দেয়া হোক। সুলতান আইউবী রিচার্ডের এই দুটি দাবি মেনে নেন। তার বাহিনীও যুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েছিলো। নিজেও একদিকে যেমন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অপরদিকে অসুস্থ। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন।
রিচার্ড মুসলমানদের চেতনা ও নির্ভীকতায় ভয় পেয়ে গেছেন। তার স্বাস্থ্যও হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া নিজ দেশে বিরুদ্ধবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছিলো। তাই তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যাওয়া তার আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।
৫৮৮ হিজরীর ২২ শাবন মোতাবেক ১১৯১ খৃস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ১১৯২ সালের ৯ অক্টোবর রিচার্ড বাহিনীসহ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিলো ৩ বছর। রিচার্ড রওনার আগে সুলতান আইউবীকে বার্তা পাঠান, চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর আমি জেরুজালেম জয় করতে আসবে। কিন্তু তারপর কোন খৃস্টান আর বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৬৭ সালে আরবদের অনৈক্য এবং তাদের সেসব দুর্বলতা, যেগুলো সুলতান আইউবীর আমলে খৃস্টানরা মুসলিম আমীরদের মাঝে জন্ম দিয়েছিলো বাইতুল মুকাদ্দাসকে ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়।