আল-মাশতুব ও কারাকুশ শর্তের ভিত্তিতে চুক্তিতে সই করেছিলেন। তথাপি সুলতান আইউবীকে দেখতে হলো, ফিরিঙ্গিরা প্রায় তিন হাজার মুসলমানকে কয়েদি বানিয়ে রশিতে বেঁধে আক্রার বাইরে নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে সামরিক লোকও আছে, বেসামরিক লোকও আছে। তাদেরকে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। চারদিক থেকে খৃস্টান বাহিনীর আরোহী ও পদাতিক সৈন্যরা সেই হাত-পা বাঁধা নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। খৃস্টানরা এতো পৈশাচিকতা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করবে, মুসলিম বাহিনীর সে ধারণা ছিলো না। যখন খৃস্টানরা মুসলিম বন্দিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, মুসলিম সৈন্যরা কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে খৃস্টানদের উপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করে বসলো। কিন্তু ততোক্ষণে হাত-পাৰ্বধা বন্দিরা শহীদ হয়ে গেছে। উভয় বাহিনীর মধ্যে আবারো তীব্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলো।
***
ইতিমধ্যে রিচার্ডও সুলতান আইউবীর ন্যায় গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার উপর খৃস্টজগতের অনেক নির্ভরতা ছিলো। লোকটি সিংহ-হৃদয় ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আক্রার অবরোধে যেখানে তিনি সফল হয়েছিলেন, সেখানে তার মনোবলও ভেঙে গিয়েছিলো। মুসলমানরা এতো প্রাণপণ লড়াই করে থাকে তার ধারণা ছিলো না। তার গন্তব্য ছিলো বায়তুল মুকাদ্দাস। আক্রী জয় করার পর রোম উপসাগরের কূল ঘেঁষে রওনা হয়েছিলেন। সম্মুখে আসকালান ও হীফা ইত্যাদি বৃহৎ নগরী ও দুর্গের অবস্থান। সুলতান আইউবী তার মতলব বুঝে ফেলেন। এই নগরী ও দুর্গগুলোকে দখল করে এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আক্রমণ করার মতলব এটেছেন।
সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাসের খাতিরে যতো বড় ও যতো বেশি প্রয়োজন কুরবানী দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি আদেশ প্রদান করেন আসকালানকে ধ্বংস করে দাও। দুর্গ ও নগরীটা ধ্বংস্তূপে পরিণত করে দাও। শুনে সালার ও উপদেষ্টাদের মাথায় যেনো বাজ পড়ে। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতো বিশাল নগরী! এতো শক্ত দুর্গ! সুলতান আইউবী গর্জে ওঠে বললেন নগরী আবার গড়ে ওঠবে। মানুষ জন্ম নিতে থাকবে। কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করার জন্য বোধ হয় সালাহুদ্দীন আইউবী আর জন্মাবে না। নিজেদের সকল নগরী এবং শিশুদেরসহ সব মানুষ মসজিদে আকসার জন্য, কুরবান করে দাও।
সুলতান আইউবী বাস্তবিকই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি বাস্তবতাকে লুকাবার চেষ্টা করেননি। গেরিলা ইউনিটগুলোকে খৃস্টান বাহিনীর পেছনে লেলিয়ে দেন। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে অগ্রসরমান রিচার্ড বাহিনীর পেছন অংশের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ফলে রিচার্ডের অগ্রযাত্রা মন্থর হয়ে যায়। তাদের রসদ অনিরাপদ হয়ে পড়ে। রিচার্ড আসকালান যাচ্ছিলেন। তিনি যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছেন, ততোক্ষণে নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে যে মুসলিম ফৌজ ছিলো, তাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রিচার্ডের পথে যে কটি দুর্গ জয় করার কথা ছিলো, সবগুলো আগেই ধুলিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মুসলমানরা এমন ত্যাগও স্বীকার করতে পারে ভেবে রিচার্ডের মাথা খারাপ হয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বুঝে ফেলেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করা সহজ হবে না।
ফ্রান্সের সম্রাট রিচার্ডকে ত্যাগ করে চলে গেছেন। এ রিচার্ডের জন্য বিরাট এক ধাক্কা। তিনি আক্ৰা জয় করেছেন ঠিক; কিন্তু এই সফলতার মধ্যেও মুসলমানরা তার কোমর ভেঙে দিয়েছে। আক্রা হাত থেকে ছুটে যাওয়া সুলতান আইউবীর জন্য আক্ষেপের বিষয় ছিলো। কিন্তু তাঁর কৌশল সফল হয়েছে যে, তিনি ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তির ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছেন। এবার তিনি পুনরায় নিজের বিশেষ পদ্ধতির যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। সে হচ্ছে, গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণের ধারা। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মুসলমান গেরিলারা রাতের অন্ধকারে ঝড়ের ন্যায় আসতো এবং খৃস্টান বাহিনীর পেছন অংশের উপর কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে বিপুল ক্ষতিসাধন করে অদৃশ্য হয়ে যেতো। ফলে খৃস্টানদের এক মাসের পথ অতিক্রম করতে তিন মাস সময় লেগে যেতো। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী ক্রুসেডারদের অগ্রযাত্রার গতি মন্থর করে দিয়ে নিজে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা শক্ত করে ফেলেন।
***
কিছু করো জুয়ানা! ক্রুশের খাতিরে কিছু একটা করো- রিচার্ড তার বোনকে বললেন- আল-আদিলকে হাত করে নাও। যুদ্ধ করে আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস নিতে পারবো না।
তিনি আমাকে চাচ্ছেন- জুয়ানা উত্তর দেয়- রওনার সময়ও তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমি বলতে পারি, তিনি আমাকে মনে-প্রাণে কামনা করছেন। কিন্তু বলছেন, আমি মুসলমান হয়ে যাই। আমার কোন শর্তই মানতে রাজি হচ্ছেন না।
ওদিকে সুলতান আইউবী ভাই আল-আদিল, পুত্রদ্বয় এবং সালারদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর মুখে এখন দুটি মাত্র বুলি- ইসলাম, বাইতুল মুকাদ্দাস। তিনি সকলকে বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। সভা শেষে আল-আদিল সুলতান আইউবীর সঙ্গে একাকীত্বে মিলিত হন এবং বললেন- রিচার্ড আমাকে তার বোনকে বিয়ে করতে বলছেন। শর্ত দিচ্ছেন, ইসলাম ত্যাগ করে আমাকে খৃস্টান হতে হবে।