আচ্ছা!- জুয়ানার হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমার সেবিকা দুটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রাতে এখানেই ছিলো। সকাল থেকে উধাও!
আমার মনে হচ্ছে, ওরা উধাও-ই থাকবে- রিচার্ড বললেন- ওরা মুসলমান ছিলো।
ওরা সিসিলির মুসলমান ছিলো- জুয়ানা বললো- আমার বিয়ের সময় থেকে ওরা আমার সঙ্গে ছিলো।
মুসলমান যেখানকারই বাসিন্দা হোক, সকলের চেতনা একরকমই হয়ে থাকে।- রিচার্ড বললেন- সে কারণেই আমরা এ জাতিটাকে বিপজ্জনক মনে করি এবং ঐক্য বিনষ্ট করে তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওরা এখানে এসে দেখলো, আমরা তাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, অমনি তাদের কাছে চলে গেলো।
রিচার্ড ঠিকই বলেছিলেন। ততোক্ষণে তারা সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে গেছে। তারা সুলতান আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বললো, এমন কিছু কথা আছে, যা সুলতানকেই বলতে হবে। তারা সুলতান আইউবীকে জানায়, আমরা সিসিলিতে জন্মগ্রহণ করেছি এবং সেখানেই লালিত-পালিত হয়েছি। শৈশব থেকেই চাকরানি হয়ে রাজমহলে সময় অতিবাহিত করেছি। সম্রাট রিচার্ডের বোন জুয়ানা রাজার স্ত্রী হওয়ার পর বয়স, রূপ-সৌন্দর্য ও দৈহিক আকার-গঠনের সুবাদে আমাদেরকে তার খাস চাকরানি নিযুক্ত করা হয়। সিসিলিতে মুসলমান ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। সে জন্য সেখানে ইসলাম জিন্দা ছিলো। আমরাও ধর্মের কথা ভুলিনি। জুয়ানা বিধবা হয়ে যাওয়ার পর সম্রাট রিচার্ড ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। এখানে আসবার সময় তিনি বোনকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এখানে এসে আমরা খৃস্টানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখে চাকরি থেকে আমাদের মন ওঠে গেছে।
মেয়ে দুটো দৈহিকভাবে মানানসই হওয়ার পাশাপাশি যেমন চালাক, তেমনি সতর্ক। তারা সুলতান আইউবীকে জানালো, জুয়ানা রিচার্ডকে বলছিলো, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই আল-আদিলকে ফাঁসিয়ে ফেলেছি। আল-আদিল যদি ধর্ম ত্যাগ করে খৃস্টান হয়ে যান, তাহলে তাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করা ও জেরুজালেম দখল করা সহজ হয়ে যাবে। মেয়ে দুটো এই সন্দেহও ব্যক্ত করে যে, জুয়ানা ও আল-আদিল গোপনে কোথাও মিলিত হয়ে থাকেন। তথ্যটা সুলতান আইউবীকে জানানোর জন্যই তারা ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। কাজী বাহউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এই মেয়ে দুটোর নাম উল্লেখ করেননি। শুধু লিখেছেন, সুলতান আইউবী তাদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে দামেশক পাঠিয়ে দেন।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মেয়ে দুটোর রিপোর্টে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন বটে; কিন্তু তাঁরই সহোদর তাকে ধোকা দিচ্ছে, এ তথ্য তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। প্রতিজন সালারের উপর তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। কিন্তু ভাই আল-আদিল ও দুপুত্র আল-আফজাল ও আয-যাহিরের উপস্থিতিতে তিনি বহু পেরেশানী থেকে মুক্ত থাকতেন। খৃস্টানদের উপর যখন পেছন থেকে আক্রমণ হতো, তার নেতৃত্ব হয় তিনি নিজে দিতেন কিংবা এই তিনজন। তাছাড়া খৃস্টান সম্রাট বিশেষত রিচার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনার দায়িত্ব আদিলের উপর ন্যস্ত ছিলো। সুলতান এ বিষয়ে আল-আদিলের সঙ্গে কথা বলা আবশ্যক মনে করলেন। কিন্তু আক্রার যুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছিলো। মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে সাহায্য আসছিলো। আল আদিলকে কোথাও দেখা যাচ্ছিলো না। তার সম্পর্কে সুলতান আইউবী শুধু এটুকু সংবাদ পাচ্ছিলেন যে, আজ তিনি অমুক স্থানে আক্রমণ করেছেন, আজ অমুক স্থানে। সুলতান তার পুত্রদেরও দেখা পাচ্ছেন না। তিনি এখন স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন।
অনবরত পাথর নিক্ষেপের ফলে আক্রান্ত প্রাচীর একস্থান থেকে ভেঙে যায়। খৃস্টানরা সে পথে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে মুসলমানরা জীবন বাজি রেখে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো, জায়গাটা উভয় পক্ষের লাশে ভরে যাচ্ছে। অবশেষে কবুতর ভেতর থেকে পয়গাম নিয়ে আসে- কাল নাগাদ যদি আমাদের কাছে সাহায্য এসে না পৌঁছায় কিংবা আপনি যদি বাইরে থেকে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা না করেন। তাহলে আমরা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হবো। কারণ, নগরীর শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে। মগরী জ্বলছে। অল্প কজন সৈন্য বেঁচে আছে। যারা বেঁচে আছে, তারাও দুবছর যাবত অবিরাম যুদ্ধ করে করে জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে।
সুলতান আইউবীর চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ সকল বাহিনীকে একত্রিত করে একযোগে তীব্র আক্রমণ চালান। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় যে, ইতিহাসের পাতা কেঁপে উঠতে শুরু করে। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মানব-মস্তিষ্ক এরূপ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কল্পনাও করতে অক্ষম। মুসলমানরা রাতেও খৃস্টানদেরকে স্থির থাকতে দেয়নি। মধ্যরাতের পর সুলতান আইউবী তাঁবুতে ফিরে এসে এমনভাবে পালংকের উপর পড়ে যান, যেনো তার দেহটা জখমে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আদেশ দেন, সকালেও এরূপ আক্রমণ হবে। কিন্তু ভোরের আলো তাকে যে দৃশ্য দেখালো, তাতে তার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। আক্রার প্রাচীরের উপর ক্রুসেডারদের পতাকা উড়ছে। খৃস্টান সৈন্যরা স্রোতের ন্যায় নগরীর ভেতরে অনুপ্রবেশ করছে। দিনটি ছিলো জুমাবার। ৫৮৭ হিজরীর ১৭ জমাদিউস সানি মোতাবেক ১২ জুলাই ১১৯২ খৃস্টাব্দ।