ইয়াকুব যখন দেখলেন, পাল ছিঁড়ে গিয়ে জাহাজ আপন গতিতে মাঝের দিকে এবং দুমশনের কজায় চলে যাচ্ছে, তখন তিনি তার জানবাজদের চীৎকার করে বললেন- আল্লাহর কসম! আমরা মর্যাদা নিয়ে মৃত্যুবরণ করবো। দুশমনকে না জাহাজ দখল করতে দেবো, না তার থেকে কোনো বস্তু ছিনিয়ে নিতে দেবো। জাহাজে ছিদ্র করে দাও। সমুদ্রকে জাহাজের ভেতর ঢুকে যেতে দাও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ইয়াকুবের যে কজন জানবাজ তখনো জীবিত ছিলো, তারা ডেকে গিয়ে জাহাজের তলদেশ ফুটো করতে শুরু করে। ছিদ্র হয়ে গেলে সাগরটা জাহাজে ঢুকতে শুরু করে। একজন জানবাজও জাহাজ থেকে লাফিয়ে জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করেনি। সকলে জাহাজসহ সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায়। এটি ১৯৯১ সালের ৮ জুনের ঘটনা।
এই দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে সুলতান আইউবী তাবু থেকে বেরিয়ে আসেন। তার ঘোড় সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতো। তিনি উচ্চশব্দে আদেশ করেন- দফ বাজাও। দফ বেজে ওঠে। এটা আক্রমণের সংকেত। অল্পক্ষণের মধ্যে তার বাহিনী আক্রমণের জন্য সমবেত হয়ে যায়। সুলতান আইউবী বললেন- আজ দুশমনকে ভেদ করে প্রাচীরের নিকট পৌঁছে যেতে হবে। তিনি ঘোড়া হাঁকান। তার সবকটি ইউনিট, আরোহী ও পদাতিক বাহিনী তার পেছনে পেছনে রওনা দেয়। বাহ্যত এটি ছিলো এলোপাতাড়ি আক্রমণ। কিন্তু সুলতান আইউবী বাহিনীকে আগেই বিন্যস্ত করে রেখেছেন। খৃষ্টানরা মুসলমানদের এরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আসতে দেখে তাদের পদাতিক বাহিনী তীর-ধনুক নিয়ে প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে যায়। তারা তীর বর্ষণ করতে শুরু করে দেয়।
আক্রমণের নেতৃত্ব সুলতান আইউবী স্বয়ং দিচ্ছিলেন। তাঁর মামলুকরা বিদ্যুতের ন্যায় ক্রুসেডারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ক্রুসেডারদের সৈন্য ছিলো অনেক বেশি। মুসলমানরা এমনভাবে যুদ্ধ করে, যেনো তাদের জীবিত পেছনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। অশ্বারোহীরা ঘোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে আর আক্রমণ করছে। এই যুদ্ধ যখন সমাপ্ত হয়, ততোক্ষণে সাঁঝের আধার নেমে এসেছে। ক্রুসেডারদের ক্ষয়ক্ষতি ছিলো বিপুল সংখ্যাতীত। কিন্তু সুলতান আইউবী যে উদ্দেশ্যে আক্রমণটা করেছিলেন, তা সাধিত হয়নি।
এরূপ হামলা এটিই প্রথম ও শেষ আক্রমণ ছিলো না। আক্ৰা দুটি বছর অবরুদ্ধ থাকে। এই সময় সুলতান আইউবী পেছন থেকে এরূপ কয়েকটি আক্ৰমণ করিয়েছেন। প্রতিটি আক্রমণেই তার জানবাজরা বীরত্বের এমন সব দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে, যেমনটি অতীতে তারাও দেখাতে পারেনি। এই সময়ে সুলতান আইউবী মিসর থেকেও সাহায্য পেয়ে যান এবং কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র তাকে সৈন্য ও সরঞ্জাম প্রেরণ করে। পুরো কাহিনী লিখতে গেলে শেষ হবে না। শুধু জিহাদের স্পৃহা নয়- সে ছিলো উন্মাদনা। সেসব আক্রমণে আক্রার অবরোধ ভাঙা যায়নি বটে; কিন্তু ক্রুসেডারদের হৃদয়ে ভয় ধরে যায় যে, মুসলমানরা এখান থেকে তাদেরকে জীবিত বেরিয়ে যেতে দেবে না। খৃস্টানদের সৈন্য বেশি ছিলো বিধায় তাদের প্রাণহানিও ঘটেছে বিপুল। এই সুবিপুল লাশ আর আহতদের দেখে খৃস্টানদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছিলো। মুসলমানদের অভাবিতপূর্ব এই বীরত্বে স্বয়ং রিচার্ডও প্রভাতি হতে শুরু করেছেন।
এ সময়ে রিচার্ড সুলতান আইউবীর নিকট সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে দূত প্রেরণ করতে থাকেন। দূত আল-আদিলের নিকট যেতো আর আল-আদিল প্রস্তাবটা সুলতানের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন। তার দাবি ছিলো, আমাদের জেরুজালেম আমাদেরকে দিয়ে দাও, আমাদের কুশটা ফিরিয়ে দাও এবং হিত্তীন যুদ্ধের আগে যেসব অঞ্চল আমাদের দখলে ছিলো, সেগুলো আমাদেরকে দিয়ে দাও। সুলতান আইউবী জেরুজালেম নাম শুনে আঁৎকে ওঠতেন। তথাপি তিনি আল-আদিলকে রিচার্ডের সঙ্গে সন্ধি বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন। প্রায় সকল ঐতিহাসিক লিখেছেন, রিচার্ড ও আল আদিল যখন রিচার্ডের নিকট যেতেন কিংবা রিচার্ড আল-আদিলের নিকট আসতেন, তখন রিচার্ডের বোন জুয়ানাও সঙ্গে থাকতো। এই বন্ধুত্ব সত্ত্বেও আল-আদিল রিচার্ডের শর্ত মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
এই সাক্ষাৎ-যোগাযোগের এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যেও যুদ্ধ অব্যাহত ছিলো। রক্তক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো এবং আক্রাবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠেছিলো। অবরোধকারীদের মধ্যে অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটও ছিলেন। তন্মধ্যে ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন উল্লেখযোগ্য। ইংল্যান্ডের ম্রাট রিচার্ড সকলের নেতৃত্ব প্রদান করছিলেন।
***
আমি এতোটুকু সফলতা অর্জন করেছি যে, তিনি আমার ভালোবাসা বরণ করে নিয়েছেন- জুয়ানা ভাই রিচার্ডকে বললেন- কিন্তু সকল মুসলমান আমীর-শাসকদের মাঝে যে দুর্বলতাটি পাওনা যায় বলে আপনি জানিয়েছেন, সেটি তার মধ্যে পাইনি। তিনি আমাকে বিবাহ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন বটে; কিন্তু তার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করার পরিবর্তে আমাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলছেন।
মনে হচ্ছে, এ বিদ্যায় পারদর্শী মেয়েরা যেভাবে যাদু প্রয়োগ করে, তুমি তেমনটি প্রয়োগ করতে সক্ষম হওনি- ভাই রিচার্ড বললেন- আল-আদিল চরিত্রে পরিপন্তু সে আমিও দেখেছি। ইতিমধ্যে আমি তাকে বলে ফেলেছি; সে (তুমি) যদি আপনাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়, তাহলে আপনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে নিন, আর ভাইকে বলুন যেনো তিনি উপকূলীয় অঞ্চলটা আপনাকে দিয়ে দেন, যেখানে আপনার স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে রাজত্ব করবেন। তিনি উত্তর দিয়েছেন, ধর্মই যদি পরিবর্তন করলাম, তাহলে এতো খুন-খারাবির আবশ্যক কী ছিলো? আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আমার বোনকে পছন্দ করেন? তিনি উত্তর দেন, সে আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করুন। তাকে আমি ততোটুকু কামনা করি, যতোটুকু সে আমাকে কামনা করে। আমি তাকে বললাম, আপনাদের এই প্রেম-ভালোবাসায় আমার কোনো আপত্তি নেই।… শিকার জালে এসে পড়েছে। এখন ধরে বোতলে ভরার দায়িত্ব তোমার।