তারা প্রাচীরের বিবরণ এভাবে প্রদান করে যে, খৃস্টানদের মিনজানিকের অনবরত পাথর নিক্ষেপের ফলে কয়েক স্থান থেকে প্রাচীর ভেঙে গেছে। উপরের অংশ শেষ হয়ে গেছে। শত্রুরা তাদের নিহত সৈনিক ও মৃত ঘোড়ার লাশ দ্বারা বাইরের পরিখা ভরাট করে দেয়ালের নিকটে আসার চেষ্টা করছে। আপনি যখন দফের শব্দ শুনতে পাবেন, তখন পেছন থেকে খৃষ্টানদের উপর অত্যন্ত তীব্র আক্রমণ চালাবেন। খৃস্টানরা যখন প্রাচীরের উপর আক্রমণ চালাবে, আমরা তখন দফ বাজাবো। আপনি এমন জানবাজ প্রস্তুত করুন, যারা সমুদ্র পথে আমাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছিয়ে দেবে।
সুলতান আইউবী জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ান। তিনি পত্রের উত্তর লেখান। তাতে তিনি আক্রাবাসীদের প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং সাহস প্রদান করেন। লিখেছেন, জানবাজরা আগেই নগরীতে অস্ত্র পৌঁছানোর জন্য চলে গেছে। আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। ইসলামের বড়ই দুর্দিন যাচ্ছে। খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাস যাওয়ার পরিবর্তে আক্ৰা আসুক এটা আমারই প্রচেষ্টা ছিলো, যাতে আমি এখানেই আটকে রেখে তাদের সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিতে পারি। তোমরা আক্তার প্রতিরক্ষার জন্য নয়- মসজিদে আকসার সুরক্ষার জন্য লড়াই করছে।
পত্রখানা পায়ে বেঁধে কবুতরটিকে রওনা করিয়ে সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের তলব করেন। বললেন, প্রতিজন কমান্ডার ও প্রত্যেক সৈনিকের নিকট গিয়ে কথা বলার সময় ও সুযোগ আমার নেই। শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তাকে আমি এই জিহাদে ব্যয় করতে চাই। আমার কমান্ডার ও সৈনিকদের বলল, তোমরা আল্লাহ, রাসূল ও ইসলামের জন্য যুদ্ধ করো। এখন আর চিন্তা করো না, তোমরা তোমাদের সুলতানের নির্দেশে যুদ্ধ করছে। এ ও ভেবো না, তোমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে বিনিময় দান করবেন।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, সুলতান আইউবী অতীতে কখনো এমন আবেগপ্রবণ হননি। মা কোলের শিশুটিকে হারিয়ে ফেললে যেমন আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে, সুলতান আইউবীও সেদিন তেমনি আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি ঘুমাতেন না। বিশ্রাম করতেন না। আমি তাকে বহুবার বলেছি, সুলতান! স্বাস্থ্যটার প্রতি একটু লক্ষ্য রাখুন। এভাবে শরীরটা একেবারে শেষ করে ফেলছেন। আল্লাহকে স্মরণ করুন। জয়-পরাজয় তারই হাতে। সুলতানের চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে এসেছিলো। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন- বাহাউদ্দীন! আমি খৃস্টানদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস দেবো না। সেই পবিত্র ভূ-খণ্ডটির অবমাননা আমি হতে দেবো না, যেখান থেকে আমার প্রিয় রাসূল আল্লাহর দরবারে মিরাজে গমন করেছিলেন। যেখানে আমার রাসূল সিজদা করেছিলেন। হঠাৎ তিনি গর্জে ওঠে বললেন, না বাহাউদ্দীন না। আমি মৃত্যুবরণ করেও ক্রুসেডারদের বাইতুল মুকাদ্দাস দেবো না।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, এক রাতে সুলতান আইউবী এতো অস্থির ছিলেন যে, আমি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থাকি। তার ঘুম আসছিলো না। আমি তাঁকে কুরআনের দুটি আয়াত স্মরণ করিয়ে বললাম, আয়াতগুলো পড়তে থাকুন। তিনি চক্ষু বন্ধ করে নেন এবং তার ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে। আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করে ওঠেন- ইয়াকুবের কোনো খবর আসেনি? সে নগরীতে ডুবে যাবে। বলে আবারো ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করি, সুলতান ঘুমের মধ্যেও অস্থিরতা প্রকাশ করছেন।
সুলতান আইউবীর তাবু থেকে আক্রার প্রাচীরটাকে এমন দেখা যেতো, যেনো পিঁপড়েরা কোনো বস্তুর উপর দলা বেঁধে আছে। রাতে আক্রার প্রাচীরের উপর প্রদীপ হাঁটা-চলা করতো। অন্ধকারে প্রাচীরের উপর দিয়ে আগুনের গোলা-ভেতরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হতো। প্রাচীর টপকে ভেতর থেকে বাইরেও তেমনি, গোলা আসত। সুলতান আইউবীর কমান্ডো সেনারা প্রতি রাতে দুশমনের উপর গেরিলা হামলা চালাতো।
***
ঘুমের ঘোরে সুলতান আইউবী যে ইয়াকুবের নাম উচ্চারণ করেছিলেন, তিনি হলেন তার নৌ-বাহিনীর একজন অতিশয় দুঃসাহসী কাপ্তান। আক্রা নগরীতে রসদ ও অস্ত্র পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। নগরীর যেদিকটায় নদী, সেদিকে খৃস্টানদের নৌ-বহর ছড়িয়ে ছিলো। অথচ নগরবাসীদের জন্য সরঞ্জাম পৌঁছানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিলো। সুলতান আইউবী ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য নৌ-বাহিনী থেকে স্বেচ্ছাসেবক তলব করেন। দুঃসাহসী কাপ্তান ইয়াকুব সুলতানের ডাকে সাড়া দেন। তত্ত্বালের কাহিনীকার কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ এবং আরো দুজন ঐতিহাসিক ইয়াকুবের কাহিনী বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি হালবের অধিবাসী ছিলেন। ইয়াকুব নৌ ও স্থল বাহিনী থেকে ৬৫০ জন সৈন্য বেছে নেন। তাদেরকে তিনি নিজ জাহাজে তুলে বৈরুত চলে যান। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ রসদ ও অস্ত্র বোঝাই করে আক্রার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেই অস্ত্র ও রসদের পরিমাণ এতো বেশি ছিলো যে, হাতে পেলে আক্রাবাসীরা দীর্ঘদিন যাবত যুদ্ধ করতে সক্ষম হতো।
ইয়াকুব তার সৈনিকদেরকে বলে রাখেন, প্রয়োজনে জীবন কুরবান করে দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে হোক জাহাজ আক্রা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু জাহাজটি আক্রার সামান্য দূরে থাকতেই খৃস্টানদের চল্লিশটি জাহাজ তাকে ঘিরে ফেলে। ইয়াকুবের জানবাজরা প্রাণপণ মোকাবেলা করে। জাহাজ চলতে থাকে এবং ইয়াকুব জাহাজটিকে আক্রার কুলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। জানবাজরা দুশমনের জাহাজগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এক ফরাসী ঐতিহাসিক দ্য উইনসোফ লিখেছেন, তারা জিন ও প্রেতাত্মার ন্যায় লড়াই করে। তবু দুশমনের ঘেরাও থেকে বেরুতে সক্ষম হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম সৈন্য খৃস্টানদের তীর খেয়ে মারা যায়।