রিচার্ড তার হবু ভগ্নিপতিকে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন। সে চলে যায়। রিচার্ড বোনকে উদ্দেশ করে বলতে শুরু করেন—
বড় ক্রুশ এবং জেরুজালেমের মর্যাদা ও পবিত্রতার দাবি হচ্ছে, তুমি ভুলে যাও, তুমি আমার বোন। তুমি সেই ক্রুশের কন্যা, যেটি মুসলমানদের দখলে চলে গেছে এবং যে জেরুজালেম আমাদের নবীর উপাসনালয় ছিলো, সেটিও এখন মুসলমানদের দখলে। তুমি জানো, আমাদেরকে ইসলামের বিনাশ সাধন করতে হবে। আর তুমি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছো, মুসলমানরা আত্মহত্যার ন্যায় যুদ্ধ করছে। এরা মৃত্যুর পরোয়া করে না। এরা বিজয় অর্জন করার লক্ষ্যে লড়াই করে। আমি এই প্রথমবার তাদের যুদ্ধ দেখলাম। এখানে আমি এই প্রথম এসেছি। মুসলমানদের উন্মাদনার যে কাহিনী কানে শুনেছিলাম, এখন তা চোখে দেখলাম। আমাকে ধারণা দেয়া হয়েছিলো, মুসলমানদেরকে ঘায়েল করার উত্তম পন্থা নারী। একজন নারী নাকি একজন ক্ষমতাধর ও যুদ্ধবাজ মুসলমানকে কুপোকাত করে ফেলতে পারে। তাদের মাঝে যে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেটি আমাদের সম্রাটগণ তাদেরকে ক্ষমতার মোহ, সোনা-মাণিক্য এবং মদ ও নারীর নেশায় আচ্ছন্ন করে সংঘটিত করিয়েছিলেন। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী লোকটা এমন পাথর যে, তাকে কোনো কিছুতেই গুলানো সম্ভব হয়নি। তার যে ভাইয়েরা আমাদের সঙ্গে এসে পড়েছিলো, তরবারীর জোরে তিনি তাদেরকে নিজের অনুগত বানিয়ে নিয়েছেন কিংবা তাদের অন্তরে ইসলামী চেতনা জাগিয়ে তুলেছেন।
হ্যাঁ, এসব আমিও শুনেছি- জুয়ানা বললো- মুসলিম আমীর ও শাসকদের নিকট গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতার জন্য আমাদের যে মেয়েদের প্রেরণ করা হতো, তাদের আত্মত্যাগের কাহিনীও শুনেছি। আমার মনে হচ্ছে, এ পদ্ধতিটা সফল হয়নি।
ব্যর্থও যায়নি- রিচার্ড বললেন- মুসলমানদের জাতীয় চেতনা বিনষ্ট করার জন্য যদি এই মেয়েগুলোকে ব্যবহার না করা হতো, তাহলে তারা বহু আগে শুধু জেরুজালেমই নয়- অর্ধেক ইউরোপ দখল করে নিতো। আমরা নারীর দেহের রূপ-যাদু প্রয়োগ করে এবং তাদের কতিপয় উজির-সালারকে সুলতান বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে দেখিয়ে তাদের ঐক্য ভেঙে দিয়েছিলাম। তাদেরকে আপসে যুদ্ধ করিয়ে করিয়ে তাদের সামরিক শক্তি খর্ব করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে।
আপনি এসব কথা আমাকে কেননা শোনাচ্ছেন? জুয়ানা বললো- আপনার বর্ণনা ভঙ্গিতে হতাশা কেনো? আমি আপনার কী সাহায্য করতে পারি?
আমি তোমাকে বলেছি, তুমি ভুলে যাও তুমি আমার বোন- রিচার্ড বললেন- তুমি ক্রুশের কন্যা। ক্রুশের বিজয়ের জন্য তুমি বহু কিছু করতে পারো। তুমি দেখতে পাচ্ছো, আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করছি আবার পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎও হচ্ছে। আমরা এক পক্ষ অপর পক্ষের নিকট দূত প্রেরণ করছি। সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই আল-আদিলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। আমি তাকে আমার কতিপয় শর্ত মান্য করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছি; কিন্তু সে মানছে না। তাকে বলেছি, তোমরা জেরুজালেম: ও বড় কুশটা আমাদের দিয়ে দাও আর তোমরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাও। সালাহুদ্দীন আইউবীও আমার দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আপনি নিজে সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন না কেন?
তিনি আমাকে সাক্ষাৎ দিতে রাজি হচ্ছেন না- রিচার্ড উত্তর দেন- তাছাড়া তিনি অসুস্থ। মনে হচ্ছে তার ভাই আল-আদিল তারই ন্যায় পরিপক্ব মুসলমান ও দৃঢ়প্রত্যয়ী। সে সালাহুদ্দীন আইউবীর স্থান দখল করছে। আমি তার মাঝে একটি দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করেছি। লোকটি যুবক এবং প্রাণোচ্ছল মনে হচ্ছে। আমি লোকটার হৃদয় জয় করার চিন্তা করছি। আমি তাকে বন্ধু বানাতে সক্ষম হবো। কিন্তু তোমার কাজ আমি কীভাবে করবো বলো। তোমার কি লোকটাকে পছন্দ হয়?
তার মানে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা দীর্ঘদিন যাবত যে কাজটা করে আসছে, আপনি আমার দ্বারা সেই কাজ নিতে চাচ্ছেন, তাই না?
হ্যাঁ- রিচার্ভ বললেন- তার হৃদয়টা জয় করে নাও। পাগলকরা ভালোবাসা প্রকাশ করো। তুমি তাকে বিয়ে করার আগ্রহ ব্যক্ত করো। আমি মধ্যখানে এসে সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবো, যদি উপকূলীয় অঞ্চলটা আপনার ভাই আর আমার বোনকে দিয়ে দেন, তাহলে আমি আল-আদিলের সঙ্গে আমার বোনের বিয়েতে প্রস্তুত আছি। তুমি আল-আদিলকে স্বধর্ম পরিত্যাগ করে খৃস্টধর্ম গ্রহণে প্রস্তুত করবে। তাকে প্রলোভন দাও, এই সুবিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের তুমি সুলতান হয়ে যাবে। আমি আশাবাদী, তুমি তাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতিপক্ষ বানাতে সক্ষম হবে।
জুয়ানা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রিচার্ড উত্তরের অপেক্ষায় তার প্রতি তাকিয়ে আছে। অবশেষে জুয়ানা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো- আমি চেষ্টা করবো।
মুসলমানদেরকে এই প্রক্রিয়ায় পরাজিত করা যেতে পারে- রিচার্ড বললেন- আমি যুদ্ধের ময়দানে তাদেরকে পরাস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। কিন্তু তার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। সে সময় পর্যন্ত সম্ভবত আমি বেঁচে থাকবো না। তাছাড়া আমাকে ইংল্যান্ডও ফিরে যেতে হবে। ওখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়। বিরোধীরা আমার অনুপস্থিতিতে সুযোগ নিচ্ছে।
***
রিচার্ডের মাথার উপর দিয়ে উড়ে আসা পায়রাটা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তাবুর সম্মুখে পাতা মাচানটার উপর এসে বসে। দারোয়ান ছুটে এসে তার পা থেকে বাঁধা বার্তাটি খুলে তাঁবুতে নিয়ে যায়। সুলতান আইউবী শরীরে বেশ দুর্বলতা অনুভব করছেন। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। তথাপি তিনি উঠে বসে বার্তাটি পড়তে শুরু করেন। বার্তাটি আক্রার শাসনকর্তা মীর কারাকুশ এবং সেনাপতি আল-মাশতুব প্রেরণ করেছেন। পত্রে তারা নতুন কোনো সংবাদ দেননি। অবস্থা শোচনীয়, নগরী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত নই ইত্যাদি। তারা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, আপনি এই আশঙ্কা রাখবেন না, জীবন থাকতে আমরা অস্ত্র সমর্পণ করবো। কিন্তু খৃস্টানদের উপর বাইরে থেকে আরো জোরদার আক্রণ করে আমাদের সাহায্য করা আপনার পক্ষে অধিক জরুরি হয়ে পড়েছে। সৈনিকদেরকে বলুন, নগরবাসীরা যেরূপ জযবার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তোমরাও তেমনি জযবার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাও। অর্ধেক নগরীর পুড়ে গেছে। সৈন্যও অর্ধেক কমে গেছে। কিন্তু জনসাধারণের জোশ-জযবা এতো প্রবল যে, তারা পানাহার ছেড়ে সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। মহিলারও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। তারা নিজেরা কম খেয়ে সৈন্যদের খাওয়াচ্ছে।