মীর কারাকুশ ছিলেন আক্রার শাসনকর্তা। প্রধান সেনাপতি আলী ইবনে আহমাদ আল-মাশতুব। তারা বারংবার সুলতান আইউবীকে পয়গাম প্রেরণ করতে থাকেন, আমরা অস্ত্র ত্যাগ করবো না। আপনারা বাইরে থেকে খৃস্টানদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখুন এবং যে কোনো প্রকারে হোক নগরীতে ফৌজ, অস্ত্র ও রসদ পৌঁছাতে থাকুন।
কিন্তু সুলতান আইউবী নগরীতে সাহায্য পৌঁছাবেন কীভাবে? জ্বরে তার। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। লাগাতার রাত জাগা, মানসিক অস্থিরতা আর চারদিকে পঁচা-গলা লাশের দুর্গন্ধ এসব সুলতান আইউবীর শারীরিক অবস্থা আরো শোচনীয় করে তুলেছে। তিন-চারদিন পর্যন্ত তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, আক্ৰা তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
৮.৭ পায়রাটি
পায়রাটি
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁবুতে অসুস্থ পড়ে আছেন। তার থেকে সামান্য দূরে আক্রার বাইরে তার জানবাজরা আক্রা অবরোধকারী খৃস্টান বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তীনের ইতিহাসে সবচে বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। কিন্তু অবরোধ ভাঙার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নগরীর ভেতরে সুলতান আইউবীর সৈন্যসংখ্যা দশ হাজার। আর বাইরে নগরী অবরোধকারী খৃস্টানরা ৫ লক্ষাধিক। সুলতান আইউবী নগরীর বাইরে খৃস্টানদের পেছনে। তাঁর কাছে আছে দশ হাজার মামলুক, যাদের উপর তার অনেক ভরসা ছিলো। তারা পেছন থেকে খৃস্টানদের উপর অত্যন্ত দুঃসাহসী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সাফল্য আসছে না। শত্রুর সংখ্যা বেশি হওয়ার পাশাপাশি অবরোধ না ভাঙার আরেকটি কারণ হচ্ছে, খৃস্টানরা আক্রার চতুর্দিকে স্থানে স্থানে গর্ত খনন করে রেখেছে। এই গর্তগুলো সুলতান আইউবীর বাহিনীর জন্য বিপজ্জনক রূপে দেখা দিয়েছে। অশ্বারোহী সৈন্যরা আক্রমণ করতে এলে ঘোড়া গর্তে পড়ে যাচ্ছে।
আক্রার বাইরে বিস্তৃত অঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। লাশের কোনো সংখ্যা নেই। আক্রার প্রাচীরের বাইরে নগরীর প্রাচীরসম দীর্ঘ ও চওড়া পরিখা ছিলো, যেটি পার হওয়া দুষ্কর ছিলো। খৃস্টানরা তাদের মৃত সৈন্য ও ঘোড়া দ্বারা সেই পরিখা ভরাট করে চলেছে। যুদ্ধের ডামাডোল এতো বেশি যে, আকাশে শকুন ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী উড়ছে না। শুকনরা নীচে নামছে এবং পেট পুরে লাশ খেয়ে খেয়ে উড়ে যাচ্ছে।
শকুন ছাড়া আছে আর একটি পাখি- একটি কবুতর। কবুতরটি প্রায় প্রতিদিন আক্রা থেকে উড়ে এসে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে অবতরণ করছে এবং বহুক্ষণ পর ক্যাম্প থেকে উড়ে আবার আক্রা ফিরে যাচ্ছে। অবরোধ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাঝে এই কবুতর একদিন আক্রা থেকে উড়াল দেয়। ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ড তাঁবুর বাইরে দণ্ডায়মান। সঙ্গে তার বোন জুয়ানাও আছে।
এই পায়রাটার উপর দৃষ্টি রাখবে- রিচার্ড আদেশ করেন- দেখামাত্র তার উপর বাজ ছেড়ে দেবে। এই একটি পায়রাই আমাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে।
বোন জুয়ানা এবং তার হবু স্বামী বেরঙ্গারিয়া রিচার্ডের নিকট দণ্ডায়মান। এই অল্প কদিন আগেও জুয়ানা সিসিলির সম্রাটের স্ত্রী ছিলো। সম্রাট মারা গেলে জুয়ানা ভর যৌবনেই বিধবা হয়ে যায়। ফিলিস্তীন জয় করে সঙ্গের ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য রিচার্ড তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। জুয়ানা এতো রূপসী যে, কেউ বলবে না মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় পথে সিসিলি থেকে রিচার্ড তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
রিচার্ড জুয়ানার হাসি শুনতে পান। বোনের দিকে ফিরে তাকালে সে জিজ্ঞেস করে- ভাইজান! এই পায়রাটি মরে গেলে কি সালাহুদ্দীন আইউবীও মরে যাবেন?
এই পায়রাটি পিয়ন জুয়ানা!- রিচার্ড বললেন- পায়ের সঙ্গে বার্তা বেঁধে ও সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট আক্রাবাসীদের চিঠি নিয়ে যায়। আইউবী এরই মাধ্যমে সেই চিঠির উত্তর আক্রায় পৌঁছিয়ে দেন। আইউবী বাইরে থেকে আমাদের উপর যে আক্রমণ চালাচ্ছেন, আক্রাবাসীদের বার্তা মোতাবেকই করে থাকেন। আক্রাবাসীদের জোশ-চেতনা এবং অস্ত্র ত্যাগ না করার প্রত্যয় এই পায়রাটির কারণেই অটুট রয়েছে জুয়ানা। অন্যথায় কোনো অবরুদ্ধ বাহিনী এতো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এমন তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে পারে না। তুমি তো দেখেছো, আমরা মিনজানিকের সাহায্যে পাথর ছুঁড়ে কয়েক স্থান থেকে প্রাচীরের উপরের অংশ ফেলে দিয়েছি এবং আমাদের নিক্ষিপ্ত গোলা নগরীতে ব্যাপক ধ্বংস সাধন করেছে। তারপরও তারা অস্ত্র ত্যাগ করছে না।
আপনার আসল উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য তো জেরুজালেম, যার থেকে আপনি এখনো অনেক দূরে- জুয়ানা বললো- আক্ৰা জয় করতে যদি কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে জীবনেও জেরুজালেম পৌঁছতে পারবেন কি? আমাদের গোয়েন্দা ও মুসলিম যুদ্ধবন্দিরা বলছে, নগরীর ভেতরে মাত্র দশ হাজার সৈন্য আছে। আমাদের সংখ্যা প্রথমে ৬ লাখ ছিলো। এখন ৫ লাখ। অবরোধ ১৯৮৯ সালের আগস্টে শুরু হয়েছিলো। এখন ১১৯১ সালের আগস্ট চলছে। দুই বছর ভাইজান! এখনো আপনি দশ হাজার অবরুদ্ধ সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেননি। আমি জানি, আপনি এই অবরোধ অভিযানে এসে যোগ দিয়েছেন মাস কয়েক হলো। কয়েক মাস সময়ও কম নয় ভাইজান। কিন্তু এই কয়েক মাসে আক্রা নগরীর সামান্য প্রাচীর ভাঙা আর মিনজানিকের সাহায্যে নগরীর কিছু অংশে আগুন লাগানো ব্যতিরেকে আপনি কোনো সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন কি? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, নগরীর ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আপনি কিছুই অর্জন করতে পারবেন না।