কারবাসের দ্বীপে এসে নোঙ্গর ফেলে রিচার্ড জানতে পারেন, ঝড় তার বহরের তিন-চারটি জাহাজকে কারবাসের কূলে এনে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তার একটিতে তার যুবতী বোন জুয়ানা এবং বোনের হবু স্বামী বেরঙ্গারিয়াও রয়েছে। এ দুজনের ব্যাপারে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তারা ডুবে মারা গেছে। এখন জানতে পারলেন তারা জীবিত ও নিরাপদ আছে। কিন্তু কাবরাসের সম্রাট আইজেক জাহাজগুলোর সমুদয় মালামাল বের করে নিয়ে গেছেন এবং বোন ও বোনের হবু স্বামীকেসহ সকলকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। রিচার্ডকে আইজেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলো। পরাজিত করে তিনি আইজেককে একটি তাঁবুতে আটকে রাখেন। কিন্তু আইজেক রাতে বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যান। রিচার্ড পনের-বিশ দিন পর্যন্ত তাকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে তাকে পাওয়া গেলো। রিচার্ড তার ঘোড়াটা নিয়ে নেন। সে এক অস্বাভাবিক দ্রুতগামী ঘোড়া। রিচার্ড যখন পবিত্র ভূমিতে যুদ্ধ করতে আসেন, তখন এই ঘোড়াটি তার সঙ্গে ছিলো।
রিচার্ড যখন পবিত্র ভূমির কূলে এসে ভিড়েন, ততোক্ষণে তার জোটভুক্ত খৃস্টানরা আক্রা অবরোধ করে ফেলেছে। সর্বপ্রথম যার বাহিনী অবরোধে অংশগ্রহণ করে, তিনি হচ্ছেন গাই অফ লুজিনান, যাকে রানী সাবীলা এই শর্তে মুক্ত করিয়েছিলেন যে, তিনি সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না। তার সঙ্গে ফিলিপ অগাস্টাসের বাহিনী এসে যুক্ত হয় এবং অবরোধ শক্ত হয়ে যায়। শহরের ভেতরে মুসলিম বাহিনীর সেনাসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। রসদ-পাতি যা ছিলো, তা এক বছরের জন্য যথেষ্ট ছিলো। অবরোধ ১১৮৯ সালের ১৩ আগস্ট শুরু হয়। আক্রা নগরীর অবস্থান হচ্ছে, তার একদিকে এল আকৃতির প্রাচীর। তিনদিকে নদী। নদীতে খৃস্টানদের নৌ-বহর বর্তমান। জাহাজগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাচীর থেকে দূরে খৃস্টান বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এভাবে স্থলের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সুলতান আইউবী নগরীতে নেই। তিনি বাইরে কোথাও অবস্থান করছেন। তিনি তার গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এবং ভাবগতি দেখিয়ে দুশমনকে আক্ৰায় টেনে এনেছেন। খৃস্টানরা যখন অবরোধ শুরু করে, তখন তাদের জানানো হয়েছিলো, আইউবী ভেতরে আছেন। কিন্তু অবরোধ সম্পন্ন হওয়ার পর যখন তাদের একটি অংশের উপর পেছন থেকে আক্রমণ হলো, তখন তাদের খবর হয়, আইউবী ভেতরে নয়- বাইরে আছেন এবং তিনি খৃস্টানদের আক্রা অবরোধকারী বাহিনীকে অবরোধ করে রেখেছেন।
সুলতান আইউবীর সমস্যা হচ্ছে, তার সৈন্য কম। তথাপি আশা করছেন, তিনি অবরোধ ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তার কামনা, অবরোধ বেশিদিন স্থায়ী হোক, যাতে খৃস্টানদের শক্তি এখানেই ব্যয় হতে থাকে। ১১৮৯ খৃস্টাব্দের ৪ অক্টোবর তিনি খৃস্টানদের উপর জোরদার আক্রমণ চালান। খৃস্টানরা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিলো। ভয়াবহ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৯ হাজার খৃস্টানসেনা মারা যায়। কিন্তু তাদের ছিলো দুলাখ সৈন্য। ৯ হাজারের মৃত্যুতে তাদের কোনো ক্ষতি হলো না। কীভাবে শহর জয় করবে, তার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে তারা। তাদের বাহিনী প্রাচীরের কাছে ঘেঁষতে ভয় পাচ্ছে। কারণ, প্রাচীরের উপর থেকে মুসলমানরা তাদের উপর তীর ছাড়াও অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছে।
খৃস্টানরা প্রাচীরের নিকটে পৌঁছে যায়। নগরীর অভ্যন্তরে পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষেপ ও প্রাচীর অতিক্রমের জন্য কাঠ দ্বারা চাকাওয়ালা উঁচু মাচান তৈরি করে নিয়েছে। এতো বিশাল মাচান যে, তাতে কয়েকশ সৈনিক দাঁড়াতে পারে। তাকে মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত দাহ্য পদার্থ ও গোলা থেকে রক্ষা করার জন্য তার ফ্রেমগুলোতে তামার পাত চড়ানো হয়েছে। তারা যখন মাচানটি প্রাচীরের সন্নিকটে নিয়ে যায়, তখন মুসলমানরা প্রাচীরের উপর থেকে তার উপর দাহ্য পদার্থের পাতিল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পদার্থগুলো মাচানের উপর গিয়ে পতিত হয় এবং অবস্থানকারী সৈনিকদের গায়েও গিয়ে পড়ে। পরপর কয়েকটি পাতিল এসে পতিত হওয়ার পর যখন মাচানটি ভিজে যায়, এবার এক এক করে প্রজ্বলমান কাঠ ছুটে আসতে শুরু করে। আগুনধরা, কাঠগুলো তেলভেজা মাচানে এসে পতিত হওয়ামাত্র মাচানে আগুন ধরে যায়। মাচান জ্বলে যায় এবং তাতে অবস্থানকারী সৈন্যরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়।
প্রাচীরের বাইরে একটি পরিখা ছিলো, যেটি পার হওয়া খৃস্টানদের জন্য দুঃসাধ্য ছিলো। তারা মাটি দ্বারা পরিখাঁটি ভরাট করতে শুরু করে। কিন্তু নগরীর ভেতরের সৈনিকরা এতোই দুঃসাহসী যে, তাদের একটি অংশ বাইরে বেরিয়ে এসে খৃস্টানদের উপর আক্রমণ করে করে ফিরে যাচ্ছে। পরিখা ভরাট করার জন্য খৃস্টানরা একটি পন্থা অবলম্বন করে যে, তারা তাদের মৃত সৈনিকদের লাশগুলো তাতে ছুঁড়ে মারছে। তখন থেকে তাদের যত সৈনিক প্রাণ হারায়, সকলের মরদেহ উক্ত পরিখায় নিক্ষেপ করা হয়। পেছন থেকে সুলতান আইউবী তাদের উপর অনবরত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু খৃস্টানদের অবরোধ দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে আরো দৃঢ় হতে থাকে।
নগরীর সঙ্গে সুলতান আইউবী বার্তাবাহী কবুতরের মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখেন। অপর মাধ্যমটি ছিলো এক ব্যক্তি, যার নাম ঈসা আল আমওয়াম। লোকটি চামড়ার গায়ে বার্তা লিখে কোমরের সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রে সাঁতার কেটে সংবাদ আদান-প্রদান করতো। কাজটা সে রাতে করতো। দুশমনের নোঙ্গরকরা জাহাজের তলে দিয়ে যাওয়া-আসা করতো। এক রাতে সে এভাবেই আসে। নগরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলে এবং লিখিত বার্তা দেয়া হয়েছিলো। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন- লোকটি যখন নিরাপদে নগরীতে গিয়ে পৌঁছতো, তখন একটি কবুতর উড়িয়ে দেয়া হতো। কবুতরটি আমাদের নিকট উড়ে আসতো। তাতে আমরা বুঝে নিতাম, ঈসা নিরাপদে পৌঁছে গেছে। আমরা কবুতরটি ফেরত উড়িয়ে দিতাম। যে রাতে সে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে গেলো, তার পরদিন কবুতর আসলো না। আমরা বুঝে ফেললাম, ঈসা ধরা পড়েছে। কয়েকদিন পর আমাদের নিকট সংবাদ আসে, ঈসার লাশ আক্রার কূলে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে। সোনাভর্তি থলেটি তার দেহের সঙ্গে বাধা ছিলো। লোকটি সোনার ওজন বহন করে সাঁতার কাটতে না পেরে ডুবে গিয়েছিলো।