মেয়েটিকে আসলরূপে ফিরিয়ে আনার বহু চেষ্টা করা হলো। কিন্তু সে এমন ধারায় কথা বলতে থাকে, যেনো অনাগত দিনগুলো দেখতে পাচ্ছে। অবশেষে দেওয়ানা সাব্যস্ত করেই মেয়েটিকে বুযুর্গের হাওয়ালা করে দেয়া হলো এবং বুযুর্গকে তার প্রতি নজর রাখতে বলা হলো।
***
সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মসজিদে আকসায় আল্লাহর সমীপে যে অশ্রু প্রবাহিত করেছিলেন, ফেরেশতারা মুক্তা মনে সেগুলো তুলে নিয়ে যায়। তিনি সর্বপ্রথম সংবাদ পান, সম্রাট ফ্রেডারিক মারা গেছেন। তার দিন কয়েক পর অপর এক খৃস্টান সম্রাট কাউন্ট হেনরির মৃত্যুর সংবাদ আসে। ইনিও খৃস্টানদের যৌথ বাহিনীর এক শরীক ছিলেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুসলমানদের দখল থেকে মুক্ত করতে এসেছিলেন। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় লিখেছেন, খৃস্টানরা কাউন্ট হেনরির মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ পেতে দেয়নি। সুলতান সংবাদটা জানতে পেরেছেন অন্যভাবে।
সুলতান আইউবীর নৌ-কমান্ডোরা খৃস্টানদের দুটি জঙ্গী নৌকা পাকড়াও করেছিলো, যেগুলো ফিলিস্তীনের তীর থেকে সামান্য দূর দিয়ে অতিক্রম করছিলো। তাতে পঞ্চাশজন খৃস্টান নৌ-সেনা ছিলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো।
পরদিন খৃষ্টানদের আরো একটি নৌকা ধরা পড়ে। তাতে একটি কোট ছিলো, যার গায়ে মনি-মুক্তা খচিত ছিলো। এটি কোনো এক সম্রাট ছাড়া কারো কোট হতে পারে না। জিজ্ঞাসাবাদে খৃস্টান সৈন্যরা বললো, এটি কাউন্ট হেনরির কোট এবং তিনি মারা গেছেন। এই নৌকায় নৌবাহিনীর কমান্ডার গোছের এক ব্যক্তি ছিলো। জানা গেলো, লোকটি কাউন্ট হেনরির ভাতিজা। তাদের সকলকে বন্দি করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হলো।
সম্রাট কাউন্ট হেনরি কীভাবে মারা গেলেন? কেউ বলেন, তিনি নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, তিনি মাত্র তিন ফুট গভীর পানিতে পড়ে মারা গেছেন। এক বর্ণনা মতে, নদীতে গোসল করতে নামবার পর তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
সুলতান আইউবী যার ব্যাপারে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তিনি হলেন ইংল্যান্ডের যুদ্ধবাজ সম্রাট রিচার্ড, যিনি ব্ল্যাক প্রিন্স নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাকে সিংহ-হৃদয় রিচার্ডও বলা হতো। লোকটি অভিজ্ঞ ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। উচ্চতায় যেমন দীর্ঘ ছিলেন, তেমনি তার বাহুও ছিলো লম্বা। তাতে তার তরবারী দুশমন পর্যন্ত পৌঁছে যেতো; কিন্তু দুশমনের তরবারী তাকে স্পর্শ করতে কষ্ট হতো। খৃস্টজগতে সকলের দৃষ্টি তার প্রতি নিবদ্ধ ছিলো। তার সামরিক শক্তিও ছিলো বেশি। তার নৌ-শক্তি ছিলো তৎকালীন পৃথিবীর সবচে বেশি শক্তিশালী। এ ব্যাপারটিই এখন সুলতান আইউবীর ভয়ের কারণ।
সুলতান আইউবীর এক নৌ-কর্মকর্তার নাম হুসামুদ্দীন লুলু। নৌ বাহিনী প্রধান আবদুল মুহসিন। সুলতান আইউবী যখন সংবাদ পেলেন, রিচার্ড তার নৌ-বহর নিয়ে আসছে, তখন আবদুল মুহসিনকে আদেশ প্রেরণ করেন, যেনো তিনি রিচার্ডের বহরের মুখোমুখি না হন এবং নিজের রণতরীগুলো ছড়িয়ে রাখেন। সুলতান আইউবী হুসামুদ্দীন লুলুকে কয়েকটি জাহাজ ও নৌকাসহ আসকালান তলব করেন। তাকে নির্দেশনা প্রদান করেন, দুশমনের জাহাজগুলোর উপর দৃষ্টি রাখবে। তবে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িত হবে না। তদস্থলে নৌ-গেরিলাদেরকে দুশমনের বিচ্ছিন্ন জাহাজগুলোকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করবে।
সুলতান আইউবী দেখতে পাচ্ছেন, সমুদ্রেও তাকে গেরিলা যুদ্ধ লড়তে হবে। সময়টা ছিলো সুলতান আইউবীর জন্য খুবই কষ্টকর। রাতে ঘুমাতেন না। তিনি মজলিশে শূরায় বলেছিলেন, আমাদেরকে একটি উপকূলীয় নগরী কুরবান করতে হবে। হতে পারে সেটি আক্রাঁ। আমি দুশমনকে বুঝাতে চাই, আমাদের যা কিছু আছে সব আক্ৰায় এবং আক্রা হাতছাড়া হয়ে গেলে মুসলমানদের কোমর ভেঙে যাবে। তারপর বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুসলমানদের দখলমুক্ত করা সহজ হবে। সুলতান আইউবী মজলিশে শূরাকে জানালেন, আমরা যদি দুশমনকে আক্রা টেনে আনতে সক্ষম হই, তাহলে দুশমন আক্রার প্রাচীরের সঙ্গেই মাথা ঠুকতে থাকবে। মজলিসে শূরা অনুমোদন প্রদান করে, আপনি যা ভালো মনে করেন, করুন।
***
এখন বাইতুল মুকাদ্দাস ও পবিত্র ভূমিকে সুলতান আইউবীর সেই অই রক্ষা করতে পারে, যা তিনি মসজিদে আকসায় ঝরিয়েছিলেন। পারে সেই দুআ, যা সুলতান আইউবী মসজিদে আকসায় সিজাবনত হয়ে করেছিলেন। উক্ত মেয়েটিও মসজিদে আকসায় দুআ করেছিলো। পরে সে সুলতান আইউবীর চোখে উঁকি দিয়ে বলেছিলো- তোমার দুশমনের জাহাজ তোমার চোখের অশ্রুতে নিমজ্জিত হতে দেখতে পাচ্ছি।
কোনো ঐতিহাসিক বলতে পারছেন না, সে রাতে সুলতান আইউবী কী দুআ করেছিলেন। তবে সব ঐতিহাসিকই বর্ণনা করেছেন, সুলতান আইউবীর ন্যায় মর্দে-মুজাহিদ রিচার্ডের যে নৌ-বহরে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন, ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়ে নোম উপসাগরে প্রবেশ করামাত্র সেই বহর। ভয়াবহ এক ঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিলো। সবগুলো জাহাজ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক পরিসংখ্যান মোতাবেক সেই বহুরে ৫২০টি ছোট জাহাজ ছিলো। বড় জাহাজ ছিলো একাধিক। বহরটি সৈন্য, ঘোড়া, রসদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিতে বোঝাই ছিলো।
ঝড়ের কবলে পড়ে বহরটি এমনভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে, রিচার্ডের নিজের জীবনই বিপন্ন হয়ে যায়। ঝড় থামার পর কয়েক দিনে যখন জাহাজগুলোকে একত্রিত করা হলো, তখন জানা গেলো, পঁচিশটি বড় জাহাজ ডুবে গেছে। দুটি বিশাল মালবাহী জাহাজও পানিতে তলিয়ে গেছে। সেগুলোতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি ছিলো। রিচার্ডকে সবচে বেশি ক্ষতিটির শিকার হতে হলো, সে হলো বিপুল নগদ অর্থ, যেগুলো তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসছিলেন, সেই বিশাল অর্থ ভাণ্ডারটি তার রোম উপসাগরের অঞ্চলে হারিয়ে গেলো।