তারপর মেয়ে দুটোর যে সফর শুরু হয়েছিলো, এহতেশাম ভাই! তুমি তা ভালোভাবেই জানেনা। নির্দয় মরুভূমি এ ধরনের পথিকদের কোন্ পরিণতিতে নিয়ে পৌঁছায়, তোমার তা জানা আছে। মেয়েটি আমাকে বলেছে, আমরা মানুষকে যেসব ধোঁকা দিয়েছিলাম, মরুভূমি আমাদেরকে তার চেয়েও বেশি নির্মম ধোঁকা দিয়েছে। আমি মরুভূমিতে নদী প্রবাহিত হতে দেখলাম। নিকটে গেলাম, তো নদী দূরে সরে গেলো। আমরা তাদের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি। আমি হাত উপরে তুলে নাড়াতাম, চীৎকার করতাম ও তাদের পেছনে পেছনে দৌড়াতাম। বহু জায়গায় আমরা পানি পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আসলে সেগুলো পানি ছিলে না।…।
মেয়েটি আমাকে বলেছে, তার যে অস্তিত্ব কায়রোর সরকারি কর্মকর্তাদের উপর যাদু প্রয়োগ করেছিলো, মরুভূমিতে সেই অস্তিত্ব মরে গেছে। তার হৃদয়ে আমাদের খোদার ভাবনা এসে গেছে এবং তার মধ্যে এই অনুভূতি কাটার ন্যায় বিদ্ধ হতে শুরু করেছে যে, ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ তাকে ধোকা দিয়েছেন আর এখন সে অন্যদের পাপের শাস্তি ভোগ করছে। তার মধ্যে বুঝ আসে, নিজের সম্ভ্রম উপস্থাপন করে কাউকে ধোকা দেয়া পুণ্যের কাজ নয়। মনে এই ভাবনাও জাগে যে, মুসলমানরা তাদের মেয়েদেরকে এভাবে ব্যবহার করে না। একদিন মরুভূমিতে তার এই অনুভূতিও জাগে, যেনো সে ও চার বান্ধবী মরে গেছে এবং নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে কিংবা প্রেতাত্মায় পরিণত হয়ে গেছে এবং নরকের ন্যায় প্রজ্বলমান প্রান্তরে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে ফিরছে।…
এক রাতে সে তার বান্ধবীকে বললো, আজীবনের লালিত বিশ্বাস থেকে আমার মন উঠে গেছে এবং এখন থেকে আমি মুসলমানের খোদাকে ডাকবো। উভয়ের ঠোঁট ও জিহ্বা কাঠের ন্যায় শুকিয়ে গিয়েছিলো। কণ্ঠনালীতে কাঁটা বিদ্ধ হচ্ছিলো। কথা বলতে তাদের কষ্ট হচ্ছিলো। আপন বিশ্বাস থেকে সরে আসা এবং শত্রুর বিশ্বাস ধারণ করার বিষয়টি তার বান্ধবী ভালো চোখে দেখেনি। তাই সে তার মতে সায় দেয়নি। একসময় বান্ধবী শুয়ে পড়লে সে দূরে এক স্থানে চলে যায়। সে সিজদা করে ও হাত তুলে মহান আল্লাহকে ডাকতে থাকে এবং গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। মেয়েটি সমগ্র রাত ক্রন্দন করে কাটায়। সিজদা ছাড়া ইবাদতের আর কোনো পন্থা তার জানা ছিলো না।…
তার ভাষ্য মতে, সে রাতেই হঠাৎ ধোয়ার ন্যায় শশ্রুমণ্ডিত এক ব্যক্তি তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। সে বললো, তুমি যদি অন্তর থেকে তাওবা করে থাকো, তাহলে তুমি যে খোদার সমীপে প্রার্থনা করেছে, তিনি এই মরুভূমি থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নেবেন।… ..
আমরা দশ-বারো দিন পর বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছি। এতোদিনে তার স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে গেছে। দেহের রূপ-লাবণ্য ফিরে এসেছে। কিন্তু কথা-বার্তা সেই দেওয়ানার ন্যায়ই বলতে থাকে। সেরূপ কথা যদি তোমার সঙ্গেও বলতো, তুমি প্রভাবিত হয়ে যেতে। সে বহুবার বলেছে, বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আর কোনদিন খৃস্টানদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। খোদা তাদেরকে পথেই ডুবিয়ে মারবেন। মেয়েটি এরূপ অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকে। রাতে তার ইবাদত শুরু হতো। পন্থা একটাই- সিজদা করা, ক্রন্দন করা ও প্রার্থনা করা।…
মেয়েটি এখন এই যার ঘরে থাকছে, আমি বহুদিন যাবত তাকে জানি। অনেক বড় আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি। আমি তাঁর ভক্ত। আমি মেয়েটিকে তার হাতে তুলে দেই।…
***
বুযুর্গ নামায পড়ে ফিরে এসেছেন। তিনি এহতেশামকে উদ্দেশ করে বললেন- যার কাছে ইলম আছে, আল্লাহ এই ফজীলত তাকেই দান করবেন এটা জরুরি নয়। জানিনা কখন কোন্ ফরিয়াদ মেয়েটির মুখ থেকে বের হয়েছিলো, আল্লাহ যা কবুল করে নিয়েছেন এবং মেয়েটিকে এই মর্যাদা দান করেছেন। মেয়েটি পাগল নয়, কাউকে ধোকাও দিচ্ছে না। নিজের ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি তাকে নামায পড়াতে ও শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার ইবাদতের সেই একই পদ্ধতি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য করছে আর যখন কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে গায়েব থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়েছে।
ও কি মসজিদে আকসায় সবসময়ই যাওয়া-আসা করে? এহতেশাম জিজ্ঞেস করে।
না- বুযুর্গ বললেন- রাতে এই প্রথমবার মসজিদে গেলো। আল আস সকালে এসে জিজ্ঞেস করলো, বললাম ও মসজিদে গেছে। আল-আস তার পেছনে চলে যায়। সম্ভবত সে পথেই তাকে পেয়ে যায়।
সন্দেহটা এখান থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে যে, যে রাতে সুলতান আইউবী মসজিদে উপস্থিত ছিলেন, কেবল সেই রাতে কেন ও মসজিদে গেলো?
আমি তার উত্তর দিতে পারবো না। বুযুর্গ বললেন।
এহতেশাম বললো, আমি মেয়েটিকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর নিকট নিয়ে যাবো। এটা আমার কর্তব্য। তারপর যা করার তিনি করবেন।
মেয়েটিকে যখন জানানো হলো, তোমাকে এহতেশামের সঙ্গে যেতে হবে, সে চুপচাপ তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। আল-আসও সঙ্গে যায়। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ এহতেশাম ও আল-আস থেকে বৃত্তান্ত শোনে মেয়েটিকেও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মেয়েটি উত্তর দেয়- এখন সমুদ্র থেকে আসা নৌবহর তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমাকে কেন ভয় করছো? আমাকে তোমাদের সুলতানের নিকট নিয়ে চলো। তিনি রাতে যে দুআ করেছেন, খোদা সব কবুল করে নিয়েছেন।
অনেক চেষ্টার পরও তার থেকে কোনো কথা বের করা গেলো না। সুলতান আইউবীকে অবহিত করা হলো। সেদিনই সুলতানের আক্রা যাওয়ার কথা ছিলো। তিনি বললেন, মেয়েটাকে নিয়ে আসো। মেয়েটি সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে সুলতানের ডান হাতটা চুম্বন করে। তারপর মাথা তুলে এগিয়ে উঁকি দিয়ে সুলতানের চোখে কী যেনো দেখে। তারপর স্বগতোক্তি করার মতো করে বললো, এই চোখগুলো থেকে রাতে সিজদার মধ্যে অশ্রু বের হয়েছিলো। তোমাদের শক্রর রণতরীগুলো এই অশ্রুতে ডুবে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রাচীরের কাছেও কেউ ঘেঁষতে পারবে না। রক্তের নদী বয়ে যাবে। তারা পথেই মারা যাবে। তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। যে অশ্রু আল্লাহর সমীপে প্রবাহিত হয়, ফেরেশতারা মুক্তা জ্ঞান করে সেগুলো তুলে নেয়। খোদা সেই মুক্তাগুলোকে বিনষ্ট করেন না। নিয়ত পরিষ্কার হলে পথও পরিষ্কার হয়ে যায়।