আমি তাকে বললাম, ঠিক ঠিক বলে দাও, তোমরা কোথায় যাচ্ছিলে? সত্য বের করার জন্য আমি তাকে হুমকি-ধমকিও দেই। কিন্তু তার বলার ধরণ ও দেওয়ানা জাতীয় কথা-বার্তায় কোনো পরিবর্তন আসলো না। সূর্যাস্তের পর আমি তাকে আমাদের মালবাহী ঘোড়ার উপর বসিয়ে গন্তব্যপানে রওনা হই।…।
আমার বাহিনী সামনের দিকে এগুতে থাকে। আমি মেয়েটির ঘোড়ার সঙ্গে অনেক পেছনে পড়ে যাই। এখন সে নিজেকে সামলাতে পারছে। কিন্তু কথা-বার্তা ঐ দরবেশদের ন্যায় বলছে। মধ্যরাতের পর আমরা যাত্রা বিরতি দেই। আমি মেয়েটিকে সকলের থেকে আলাদা রাখি এবং নিজে তার সঙ্গে থাকি। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়– যেতে চাও? সে বললো, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো। বললাম, আমি তোমাকে কয়েদখানায় নিয়ে যাচ্ছি। সে বললো, অসুবিধা নেই। শুনেছি খোদা কয়েদখানায়ও থাকেন। তারপর আমি অন্য পন্থা অবলম্বন করি। আমি তার বেশ আপন ও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই। ভাবলাম, হয়তো সে আমার সঙ্গে সওদাবাজি শুরু করবে এবং প্রলোভন দেখিয়ে বলবে, আমাকে খৃস্টানদের কোনো এক অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দাও। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হলো না। এসবের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপই করলো না। পরবর্তী রাতে সে নিজের আসল পরিচয় প্রদান করে।…
মেয়েটি বললো, সে দেড় বছর কায়রোতে ছিলো। সেখানে তার পরিচয় ছিলো, সে বড় এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কন্যা। এক মুসলিম শাসকের গণিকা ছিলো। মিসর সরকারের দুজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে তার শত্রুতে পরিণত করে। তারপর তিনজনকে আপসে দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে। কায়রোর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। দুজন খৃস্টান গোয়েন্দাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করায়। একজন বিপজ্জনক খৃস্টান গোয়েন্দা ও নাশকতাকারীকে- যার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা ছিলো সেই মুসলিম কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ফেরার করায়। অবশেষে মিসরের গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে হত্যা করার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো।…
সেই মুহূর্তে সে হিত্তীন যুদ্ধের ফলাফলের কথা জানতে পারে। এ-ও অবহিত হয় যে, তাদের বড় ক্রুশ সুলতান আইউবীর হাতে চলে গেছে আর সেই ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয়েছেন। মেয়েটি এ সংবাদও পায় যে, কয়েকজন খৃস্টান সম্রাট মারা গেছেন। কতিপয় যুদ্ধবন্দি : হয়েছেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের শাসনকর্তা গাই অফ লুজিনানও বন্দি হয়েছেন। এ সংবাদগুলো তার মাথায় হাতুড়ির ন্যায় আঘাত করতে থাকে। তারপর সে আরো দুটি সংবাদ পায়, তাদের চরবৃত্তি ও নাশকতার শুরু হারমান বন্দি হয়েছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে চলে গেছে। এসব সংবাদ তার মাথাটা উলোট-পালট করে দিয়েছে। তাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং প্রস্তুত করে কায়রো পাঠানো হয়েছিলো। পাপের প্রশিক্ষণটা শৈশবেই হয়েছিলো। তার ভেতরে চেতনার স্থলে ধোকা ও প্রতারণা ভরে দেয়া হয়েছিলো। তাকে জানানো হয়েছিলো, তোমাকে বড় কুশ এবং যীশুখৃস্টের সন্তুষ্টির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের পর আক্রার বড় গীর্জায় ক্রুশের প্রধান পাদ্রী তাকে আশির্বাদ করেছিলেন।…
বিদায়ের প্রাক্কালে পাদ্রী তাকে বলেছিলেন, ক্রুশের রাজত্ব অজেয় এবং তার কেন্দ্র জেরুজালেম, যার সন্নিকটে হযরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো। তাকে আরো বলা হয়েছিলো, ইসলাম কোনো ধর্ম নয় এবং মুসলমানদেরকে খৃস্টধর্মে দিক্ষিত করা কিংবা তাদের হত্যা করে পৃথিবীকে মুসলমানমুক্ত করা পুণ্যের কাজ। আর এই যে মেয়েরা ক্রুশের নামে সম্ভ্রম বিসর্জন দিচ্ছে, তাদেরকে পরজগতে স্বর্গের হুর বানানো হবে। এভাবে পাপকে পুণ্যরূপে উপস্থাপন করে মেয়েটিকে প্রস্তুত করা হয়েছিলো।…
পরে যখন সে জানতে পারলো বড় কুশও তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন তার বিশ্বাস লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সে দেখতে পায়, কায়রোতে তার যে পুরুষ সহকর্মীরা ছিলো, তারা, ওখান থেকে পালাতে শুরু করেছে। একদিন এক সঙ্গীর সন্ধানে গিয়ে জানতে পারে, সে উধাও হয়ে গেছে। অপর এক সঙ্গী তাকে বললো, এখন আমাদেরকে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো কেউ নেই। ভালো হবে, মুসলমান হয়ে কোনো একজন মুসলমানকে বিয়ে করে নাও। নতুবা এখান থেকে পালিয়ে যাও।…
মেয়েটি পাগলের মতো হয়ে যায়। সে তার এক বান্ধবীকে সঙ্গে নেয়। এক মুসলমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার প্রেমিক ছিলো। ফাঁকি দিয়ে তার থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে সন্ধ্যার সময় দুজন বেরিয়ে পড়ে। অন্ধকার গাঢ় হলে নগরী থেকে বেরিয়ে আসে। তারা খাবার-পানির কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। কিন্তু মরুভূমির সফর সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। কোথায় যাবে, তাও তারা জানতো না। আশা ছিলো, পথে কোথাও খৃস্টান সেনাদল পেয়ে যাবে। কিন্তু তাদের নির্বুদ্ধিতা ছিলো, পথঘাট সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা না নিয়েই রওনা হয়েছিলো।…
রাতটা কেটে গেছে। তারা ঘোড়া দ্রুত হাঁকিয়েছিলো। পরদিন সূর্যটা মাথার উপর উঠে এসে যখন মরুভূমিকে ঝলসে দিতে শুরু করে, তখন ঘোড়া ক্লান্তি ও পিপাসায় বেহাল হয়ে যেতে শুরু করে। তাদের অবস্থা। শোচনীয় হয়ে ওঠে। তারা মরুভূমিতে পানি ও শ্যামলিমা দেখতে শুরু করে। সেগুলোর পেছনে পেছনে তারা ঘোড়া হাঁকিয়ে চলতে থাকে। সেদিনটি ঘোড়া কিছুটা সঙ্গ দেয় বটে; কিন্তু পরদিনও যখন পানাহারের জন্য কিছু জোটেনি, তখন ঘোড়া দুটো প্রথমে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর লুটিয়ে পড়ে। অতপর আর ওঠে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।…