আর বসা থেকে ওঠে এসে যে মেয়েটি আমার পায়ের কাছে পড়ে গিয়েছিলো, তার দেহ গরম। এ প্রেতাত্মা কিংবা পরী হতে পারে না। আল্লাহ আমাকে বিবেক ও সাহস দান করেছেন। আমি আমার বাহিনীকে ডাক দেই। আমাদের সঙ্গে খাবার-পানি সবই ছিলো। সঙ্গীদের বললাম, তাড়াতাড়ি দুটি চাদর আর কিছু পানি নিয়ে আসো। তারা চাদর ও পানি নিয়ে আসে। সূর্য এখনো মাথার উপর আসেনি। এখানে উঁচু টিলার ছায়া ছিলো। আমি একখানা চাদর টিলার পাদদেশে ছায়ায় বিছিয়ে তার উপর সংজ্ঞাহীন মেয়েটিকে শুইয়ে দেই এবং অপর চাদর দ্বারা ভালোভাবে ঢেকে রাখি। তার মুখে পানির ছিটা দেই। মুখটা খোলা ছিলো। তাতে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঢেলে দেই। পানি তার কণ্ঠনালী গড়িয়ে ভেতরে চলে যায়।…
সঙ্গীরা আমাকে বারণ করছে, অহেতুক বিপদ ডেকে এনো না। কিন্তু এখন আর আমার কোনো ভয় লাগছে না। সঙ্গীদের কথাও কোনো ক্রিয়া করছে না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে। ঠোঁট দুটো একত্র হয়ে আবার খুলে যায়। আমি আবারো তার মুখে পানি দেই। তারপর আটি বের করে একটি খেজুর তার মুখে রাখি। সে খেতে শুরু করে। এবার মেয়েটি উঠে বসবার চেষ্টা করে। আমি তাকে ধরে তুলে বসিয়ে দেই।
আল-আস এহতেশামকে কাহিনী শোনাচ্ছে—
আমি তাকে খাবার খেতে দেই। খাবার খেয়ে সে পানি পান করে। আরো খেতে চাইলে খালি পেটে অতো খাওয়া ঠিক হবে না বলে বারণ করি। সে ক্ষীণকণ্ঠে বললো, আমি তোমার ভাষা বুঝি ও বলতে পারি। ঐ মেয়েটি মারা গেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কারা? বললাম, আমরা ইসলামী ফৌজের কমান্ডো সেনা। বাইতুল মুকাদ্দাস যাচ্ছি। সে বললো, তাহলে তো তোমাদের থেকে কোনো করুণা আশা করতে পারি না। আমি বললাম, তুমি বোধ হয় মুসলমান নও। সে বললো, আমি মিথ্যা, বলবো না। তবে সত্য বললেও তুমি আক্ষেপ করবে, কেননা বাঁচিয়ে রাখলাম। আমি বললাম, তুমি শুধু এটুকু নিশ্চিত করো, তুমি মানুষ। শুনে মেয়েটি ফিক করে হেসে ওঠে। আস্তে আস্তে তার চেহারার রং বদলে যেতে শুরু করে। দেহে রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়ে গেছে।…
সহসা মেয়েটির দুচোখের পাতা বুজে আসে। তার ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎই সে অবোধ শিশুর ন্যায় একদিকে কাৎ হয়ে পড়ে গিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
আমরা অনেক খুন ও লুণ্ঠন করেছি। বহু কমান্ডো আক্রমণ চালিয়েছি। কয়েকজন সঙ্গী আমাদের চোখের সামনে শহীদ হয়েছে। মরা আর মারা আমাদের জন্য ছিলো শিশুর খেলার ন্যায়। কিন্তু একজন নারীর উপর হাত তোলা- হোক সে আমাদের শত্রু- আমরা মহাপাপ মনে করেছি। আমি সঙ্গীদের বললাম, সূর্য মাথার উপর উঠে আসছে। একটু পর এখানে ছায়া থাকবে না। আশপাশে ছায়া খুঁজে বের করে বিশ্রাম নাও। মেয়েটি জাগ্রত হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হবো।..
আমার এক-দুজন সঙ্গী বললো, মেয়েটি গুপ্তচর মনে হচ্ছে। অন্যরা ভিন্নমত পোষণ করে বললো, এখানে নারী গুপ্তচরের কী কাজ থাকতে পারে? এরা গুপ্তচরও নয়- মানুষও নয়। আমি বললাম, আমরা গেরিলা সৈনিক। মিসর ও ফিলিস্তীনের সীমান্ত অঞ্চলে তৎপর ছিলাম। আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এদেরকে এখানে পাঠানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পরক্ষণে নিজের মধ্যেই সন্দেহ জাগে, তা-ই যদি হতো, তাহলে কমপক্ষে এক-দুজন পুরুষও তো থাকতো।
সূর্যাস্তের খানিক আগে মেয়েটির ঘুম ভেঙে যায় এবং উঠে বসে। আমি তার নিকটে গিয়ে বসি। সে পানি পান করে আরো কিছু খেতে চায়। আমি তাকে খাবার দেই। এবার সে ভালোভাবে কথা বলতে পারছে। মৃত মহিলার প্রতি ইঙ্গিত করে বললো, ওকে দাফন করে ফেলল। আমার। সৈনিকরা ধার্মিক ছিলো। একজন নিজের চাদরটা দিয়ে দেয়। আমরা একটা কবর খনন করে চাদরে পেঁচিয়ে লাশটা দাফন করে রাখি।
আল-আস এহতেশামকে জানায়–
মেয়েটি তারা কারা, কোথা থেকে আসলো, কোথায় যাচ্ছে- এসব বলরি পরিবর্তে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি কখনো খোদাকে দেখেছো? উত্তরে আমার যা বুঝে আসলো বললাম। সে বললো, আমি তোমার খোদাকে দেখেছি। এই এইমাত্র দেখেছি। বলবে, তুমি স্বপ্ন দেখেছে। খোদা আমাকে বলেছেন, আমি তোমাকে চোখ দিয়েছি। অন্ধকারেও তুমি আমাকে দেখতে পাবে। তিনি আরো বলেছেন, তুমি পাপ করেছে। এরপর যদি কখনো পাপের চিন্তা করো, তাহলে তোমার নিজ হাতেরই খঞ্জর দ্বারা তোমার চোখ দুটো তুলে ফেলবো। খোদা আমাকে এ কথাও বলেছেন, আমি তোমাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখান থেকে আমি আমার প্রিয় রাসূলকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছিলাম।…।
মেয়েটি এমন অনেক কথা বলে, যাদ্বারা প্রমাণিত হয়, মরুভূমির কষ্টকর সফর আর নানাবিধ বিপদাপদ তার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে। যেমন, সে বললো, তোমরা আমার দেহটা ঢেকে দিয়েছো কেন? তাকে উলঙ্গই থাকতে দিলে কী হতো? আমি এখন শরীর নই- আত্মা। আত্মা যদি পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে দেহের পাপরাশি মুছে যায় ইত্যাদি। সে বেশিরভাগ এ জাতীয় কথা-বার্তাই বলতে থাকে। তাতে আমি নিশ্চিত হই, মেয়েটি অন্যকিছু নয়- মানুষই। আর তার বলা ছাড়াই আমার জানা হয়ে গেছে, এরা সেই খৃস্টান মেয়েদের দলভুক্ত, যাদেকে আমাদের আমীর উজির ও সালারদেরকে গাদ্দার বানানোর লক্ষ্যে আমাদের দেশে প্রেরণ করা হয়। আমার মনে সন্দেহ জাগে, মেয়েটি আমাদেরকে বোকা ঠাওরানোর চেষ্টা করছে। তার মাথাটা আসলে সম্পূর্ণ ঠিক আছে।…