আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এমনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রাত কেটে গেছে। ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়। আমরা সারারাত পালাক্রমে তার উপর নজর রাখি। আযানের পর বেরিয়ে আসবার সময় মসজিদের বাতির আলোতে কম্বলের ফাঁক দিয়ে আমি তার পা দেখেছি। হাতও দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে সে হাতখানা কম্বলে ঢেকে ফেলে। আমি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করি।
হ্যাঁ, বন্ধু!- আল-আস বললো- তুমি ঠিক দেখেছো। লোকটি পুরুষ নয়- নারী। আর খুবই রূপসী ও যুবতী। আমি তোমাকে আরো বলে দিচ্ছি, মেয়েটি একজন গুনাহগার নারী, যে কিনা বিগত দশ বছর আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করেছিলো।
খৃস্টান?
খৃস্টান ছিলো- আল-আস উত্তর দেয়- এখন মুসলমান। আমি তাকে এক মুসলমানের ঘরে রেখেছি। তুমি তাকে দেওয়ানা বলতে পারো। দরবেশদের ন্যায় কথা বলে।
আর তুমি তার কথায় বিশ্বাস করেছে- এহতেশাম বললো- তুমি রণাঙ্গনের যোদ্ধা। এই নারীদের ছলনা বুঝবে না।
আমার সঙ্গে আসো- আল-আস বললো- তাকে দেখো, তার সঙ্গে কথা বলো। সন্দেহ দূর করো। এটা তোমারই কাজ। বিষয়টা তুমিই ভালো বুঝবে। এটা সত্য যে, আমি তার কথায় বিশ্বাস করেছি। তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা আমিই করেছি। তুমি আমার সঙ্গে আসো।
এহতেশাম আল-আসের সঙ্গে চলে যায়।
***
সেটি এক বুযুর্গের ঘর, যিনি দীর্ঘদিন যাবত বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করছেন। এহতেশাম ও আল-আস তাঁর দেউড়িতে গিয়ে বসে। বুযুর্গ নামায পড়তে মসজিদে গেছেন। এহতেশাম আল-আসকে বললো, আচ্ছা, উনি আসুন। এই ফাঁকে বলো তো, মেয়েটি কোথা থেকে কীভাবে এসেছে। তার ব্যাপারে আরো যা জানো বলো।
গত গ্রীষ্মের ঘটনা- আল-আস বলতে শুরু করে। আমি মিসরের সীমান্ত থেকে সামান্য দূরে গেরিলাদের একটি ইউনিটে ছিলাম। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় হয়ে গেছে। টিলা-পাথর ও মরুভূমিতে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। ওখানে আমাদের কোনো কাজ ছিলো না। একসময় আমাদেরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। আমার হাতে একটি সেনাদলের কমান্ড অর্পণ করা হয়। সঙ্গে খোলজন গেরিলা ছিলো। প্রতিটি দল নিজ নিজ গতিতে ফিরে আসছিলো। একস্থানে অনেকগুলো টিলা স্তম্ভের ন্যায় দণ্ডায়মান ছিলো। কোনো কোনোটি অতিশয় ভয়ঙ্কর ও বিস্ময়কর লাগছিলো। আমার এক গেরিলা রসিকতা করে বললো, এগুলো জিন-পরীদের প্রাসাদ। এখানে রূপসী ও দুশ্চরিত্র নারীর প্রেতাত্মাও থাকতে পারে। শুনে আমাদের হাসি পায়। আমরা টিলাগুলোর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ি।
সেগুলোর চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর স্থানেও আমরা রাত যাপন করেছি। এমন এমন জায়গায়ও বহু রাত ঘুমিয়েছি, যেখানে মানব কংকাল, মাথার খুলি ইত্যাদি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এই টিলাগুলোর ভেতরে ঢোকামাত্র ভয়ে আমাদের সর্বাঙ্গ কাটা দিয়ে ওঠে। আমরা দাঁড়িয়ে যাই। আমি জীবনে এই প্রথমবার ভয় কী জিনিস অনুভব করি। আমার গোটা বাহিনী দাঁড়িয়ে গিয়ে দুআ-দরুদ পড়তে শুরু করে। সামনে এক টিলার ছায়ায় এক মহিলা বসে আছে। মহিলার সর্বাঙ্গ বিবস্ত্র- একদম জন্মকালীন পোশাক পরিহিত। তার সম্মুখে আরেক নারী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে- সেও উলঙ্গ। উপবিষ্ট মহিলাকে যুবতী বলে মনে হলো। তার গায়ের রং গৌর। ওষ্ঠাধর মরুভূমির বালির ন্যায় শুষ্ক ও ফাটা ফাটা। মুখটা খোলা। মাথার চুলগুলো বিক্ষিপ্ত। উলঙ্গ দেহের হাড়গোড় দেখা যাচ্ছে। তবে এই অবস্থায়ও বুঝা যাচ্ছে, মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী।….
মনে প্রশ্ন জাগে- এরা মানুষ না অন্যকিছু। মাথায় উত্তর আসে না, মানুষ হতে পারে না। এটা তো চলাচলের পথ নয় যে, এখান দিয়ে মানুষ গমনাগমন করছে আর দস্যু-তস্করা তাদের লুটে নিয়ে গেছে এবং এরা রক্ষা পেয়ে এখানে এসে লুকিয়ে রয়েছে। আমি আমার সৈনিকদেরকে ভয় দেখাতে চাইলাম না। কিন্তু তারা নিজেরাই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। আমার হৃদয়েও প্রত্যয় জন্মে গেছে, এরা পাপিষ্ঠ নারীর প্রেতাত্মা বৈ নয়। আমি এই আশায় দূরেই দাঁড়িয়ে থাকি যে, ওরা: অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু উপবিষ্টজন বসেই থাকলো আর শায়িতজন শুয়েই রইলো। উপবিষ্টজন পিট পিট চোখে আমাদের দেখতে থাকে। আমার এক সঙ্গী আমাকে কানে কানে বললো, চলুন পেছনে ফিরে যাই। পাশের থেকে একজন বললো, হ্যাঁ চলে যাওয়াই ভালো হবে। তবে এদের দিকে পিঠ দেয়া যাবে না। ভয়ে সকলের গা ছম ছম করছে।
তাদের ও আমাদের মাঝে ব্যবধান বড়জোর পনের পা। আমরা সকলে খুব ধীরে একপা-একুপা করে পেছনে সরে যেতে থাকি। এবার বসা মেয়েটি মাথায় ইঙ্গিত করে, যেনো আমাদের ডাকছে। আমি পেছন পানে আরো একপা তুললে সে আবারো মাথা দ্বারা ইশারা করে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই, তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। আমি বাস্তবিক কোনো শব্দ শুনেছিলাম, নাকি মনে কল্পনা এসেছিলো ঠিক বলতে পারবো না। আমার কানে শব্দ আসে- পলায়ন করো না আল-আস! ওরা মানুষ বৈ নয়। হঠাৎ আমার ডান হাতটা কোমরে চলে যায়। তরবারীটা খুলে এনে কোষমুক্ত করে ফেলি। আমার পা আপনা-আপনি সামনের দিকে এগুতে শুরু করে। আমি সঙ্গীদের কথা শুনতে পাই। তারা আমাকে সম্মুখে যেতে বারণ করছে। আমি আয়াতুল কুরসী পাঠ করতে শুরু করি।
আমি মেয়েটি থেকে তিন-চার পা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। সে ধীরে ধীরে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর আমার দিকে পা বাড়ায়। তার মাথাটা দুলছে। একপা এগিয়ে আরেক পা তুলতে উদ্যত হয়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ এমনভাবে পড়ে যায় যে, তার মাথাটা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে এবং মাথার চুলগুলো আমার পায়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে। আমি উলঙ্গ নারীর গায়ে হাত লাগাতে ইতস্তত করছিলাম। তাছাড়া ভয় তো আছেই। আমার দেখবার ছিলো, মেয়েটি মানুষ না অন্যকিছু। আমি বসে তার শিরায় হাত রাখি। শিরা চলছে। মনে ধারণা জন্মে, জিন-পরীদের হয়তো শিরা থাকে না। এবার তার থেকে সরে আমি শুয়ে থাকা মেয়েটির শিরা দেখি। কাঠফাটা গরম সত্ত্বেও তার দেহটা রাতের মরুভূমির বালির ন্যায় অস্বাভাবিক শীতল। তার শিরায় প্রাণ নেই। মুখটা খোলা। চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে। শরীরটা সাদা। আমি তার মধ্যে মৃত্যুর সব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করি।…