সুলতান আইউবীর জন্য এ এক বিশাল ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ, যা তাকে বরণ করে নিতে হলো। কিন্তু তিনি এই ঝড়ের মোকাবেলা কীভাবে করবেন। তার বাহিনী চারটি বছর অবিরাম যুদ্ধ করছে। গেরিলা ও কমান্ডো সেনারা পাহাড়-জঙ্গলে যুদ্ধ করেছে আর জীবন বিলাচ্ছে। নিজেও অনুরূপ জীবন অতিবাহিত করছেন। কাজেই বাহ্যিক বিবেচনায় এখন তার এই বাহিনী যুদ্ধ করার উপযোগী নয়। কতো আর পারা যায়। শুধু ঈমানী চেতনার জোরে এই স্বল্প ও ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বাহিনীটির ৬ লাখ তরতাজা খৃস্টান বাহিনীর মোকাবেলা করা কীভাবে সম্ভব?
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, সুলতান আইউবীর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, তিনি রাতে ঘুমাতেন না। প্রতি মুহূর্ত গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতেন এবং মাথায় যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে থাকতেন। তার স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছিলো। একবার অসুস্থও হয়ে পড়েন। তিন দিন বিছানায় পড়ে থেকে চতুর্থ দিন ওঠে বসেন। কিন্তু শরীরে পূর্বের শক্তি আর ফিরে আসেনি। তখন বয়স হয়েছিলো ৫৪ বছর। যৌবনে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং এখনো পাহাড়-বন-বিয়াবনে যুদ্ধ করছেন। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করবেন বলে কসম খেয়েছিলেন। সে কসম তিনি পূর্ণ করেছেন। তারপর প্রতিজ্ঞা নেন, যে কদিন বেঁচে থাকবেন বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ইসলামের পতাকা অপসারিত হতে দেবেন না। এই প্রতিজ্ঞাই তাঁর আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো।
***
আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও সমর বিশেষজ্ঞ এ্যান্থনি ওয়েস্ট হারল্ড ল্যাম্ব, লেনপোল, গিবন ও আরনল্ড প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের সূত্রে লিখেছেন- সুলতান আইউবী একদিন মসজিদে গিয়ে বসেন। সারাদিন আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দুআ করতে থাকেন, যেনো এই নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাকে ইসলামী বাহিনীকে সঠিক ও নির্ভুল নেতৃত্বদানের তাওফীক দান করেন। তার চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিলো। সন্ধ্যা হয়ে গেলে তিনি মসজিদ থেকে বের হন। তখন তাঁর চেহারায় স্থিরতা ও প্রশান্তি ছিলো।
এ কথা ঠিক যে, সুলতান আইউবী মসজিদে গিয়ে সিজদাবনত; হয়েছিলেন এবং কেঁদে কেঁদে মহান আল্লাহর দরবারে সাহায্য ও দিক নির্দেশনা প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ও কাহিনীকারগণ লিখেছেন, সুলতান দিনে নয়- রাতে মসজিদে আকসায়। গিয়েছিলেন। তিনি সারারাত নামায, দুআ, দরূদ ও অজীফা পাঠে অতিবাহিত করেন এবং ফজর নামায আদায় করে মসজিদ থেকে বের হন।
সে রাতে মসজিদে তিনি একা ছিলেন না। মসজিদের বারান্দায় এক কোণে এক ব্যক্তি গায়ে কম্বল জড়িয়ে বসে ছিলো। লোকটি কখনো সিজদা করছিলো, কখনো হাত তুলে দুআ করছিলো। লোকজন ঈশার নামায আদায় করে মসজিদ থেকে চলে যাওযার পর লোকটি মসজিদে এসে বসেছিলো। মুখটা তার কম্বলে ঢাকা ছিলো।
মুআজ্জিন যখন ফজরের আযান দেন, তখন সে নিজেকে কম্বলে ঢেকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়, এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করার সময় তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখতে থাকে। তারপর লোকটার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করে। কম্বলওয়ালা ব্যক্তি ঘুরে পেছন পানে এক নজর তাকিয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। তাকে অনুসরণকারী লোকটিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। সামনে একস্থানে অপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলো। কম্বলওয়ালা তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং কী যেনো বলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তৃতীয় ব্যক্তি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। অনুসরণকারী লোকটি তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, লোকটি কে ছিলো?
উহ্ তুমি- লোকটি বললো- তুমি ওকে অনুসরণ করছিলে?
আমি তার পা দেখেছি- অনুসরণকারী লোকটি বললো- লোকটি পুরুষ নয়- নারী। তোমার আত্মীয়? তুমি তাকে চেনো?
এহতেশাম!- লোকটি বললো- আমি জানি, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করছে। যে কারো উপর নজর রাখা তোমার কর্তব্যের অংশ। আমি তোমার থেকে কিছুই গোপন রাখবো না। কিন্তু একজন নারীর মসজিদে যাওয়া গুনাহ তো নয়।
তা ঠিক- এহতেশাম বললো- আমার সন্দেহটা হচ্ছে, সে নিজেকে কম্বলে মুড়িয়ে রেখেছে কেনো? শোনো আল-আস! রাতে আমরা তিনজন লোক মসজিদের চারদিকে পাহারার জন্য ঘোরাফেরা করতে থাকি। কারণ, সুলতান ভেতরে ছিলেন। তবে তিনি বিষয়টা জানতেন না। তিনি কাউকে কিছু না বলে মসজিদে এসেছিলেন। তিনি জানেন, তার পোশাকী রক্ষীদের ছাড়াও কেউ তার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। এটা হাসান ইবনে আবদুল্লাহর ব্যবস্থাপনা। তুমি স্বয়ং ফৌজের একজন কমান্ডার। আমাকে তুমি ভালোভাবেই জানো। সে কারণে কথাগুলো এতো খোলাখুলি বলছি।
বলল এহতেশাম!- আল-আস বললো- বাইতুল মুকাদ্দাসে এবং মসজিদে আকসার এত নিকটে দাঁড়িয়ে কোনো মুসলমান মিথ্যা বলতে পারে না। আমি তোমাকে বলে দেবো, মেয়েটা কে। তার আগে তুমি বলল, তার উপর কেননা তোমার সন্দেহ জেগেছে।
আমি রাতে তাকে বারান্দার কোণে দেখেছি- এহতেশাম উত্তর দেয় সুলতানের নিরাপত্তার খাতিরে তাকে ওখান থেকে তুলে দেয়া আবশ্যক ছিলো। ঈশার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। লোকটার চলে যাওয়া উচিত ছিলো। তখন সুলতান মিম্বরের সামনে ইবাদত ও অজীফায় মগ্ন ছিলেন। এই লোকটি কম্বলে ঢাকা ছিলো। সুলতানের উপর সংহারী আক্রমণ হতে পারতো। কিন্তু মসজিদ থেকে তো কাউকে বের করে দেয়া যায় না। আমি এ-ও দেখলাম, লোকটা অভিনব এক পন্থায় ইবাদত করছে। সিজদা করছে, উঠছে আর দুআর জন্য হাত উত্তোলন করছে। সে নিয়ম অনুযায়ী নামায পড়েনি। আমি আমার সঙ্গীদের বিষয়টা জানালাম। তারা একজন একজন করে ভেতরে গিয়ে এমনভাবে দেখে যে, সে টের পায়নি কেউ তাকে দেখছে। তারা বেরিয়ে এসে বললো, সন্দেহভাজন- নজর রাখতে হবে। কিন্তু তুলে দেয়া যাবে না। কারণ, আমি তার একেবারে পেছনে বসে তার হেঁচকি শুনেছি এবং কিছু শব্দও শুনেছি। যেন সে নিজ পাপের ক্ষমা এবং খৃস্টানদের পরাজয়ের দুআ করছিলো।…