তোমরা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে উঠে না দাঁড়াও, তাহলে সমগ্র ইউরোপ থেকে ক্রুশ উৎখাত হয়ে যাবে এবং সর্বত্র ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়ে যাবে। এই যুদ্ধ সালাহুদ্দীন আইউবীর ব্যক্তিগত যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ খৃষ্টবাদ ও ইসলামের যুদ্ধ। আমাদের বড় ক্রুশ মুসলমানদের দখলে। জেরুজালেমের উপর মুসলমানদের পতাকা উড়ছে। হাজার হাজার খৃষ্টান নারী মুসলমানদের কবলে চলে গেছে। তাদেরকে মুসলিম সৈন্যদের মাঝে বন্টন করে দেয়া হচ্ছে। তোমরা কি ঘরে বসে ইসলামের ক্রমবর্ধমান এই ঝডুকে প্রতিহত করতে পারবে? তোমরা কী করে সহ্য করছো, যে ক্রুশের উপর হযরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো, সেটি মুসলমানদের হাতে চলে যাবে?
এ জাতীয় উত্তেজনাকর সত্য-মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে পোপ বড় বড় খৃস্টান কমান্ডারদের উত্তেজিত করে তোলেন। জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিক দুলাখ সৈন্য নিয়ে সকলের আগে চলে আসেন। তিনি কারো সঙ্গে জোট বাঁধবার প্রয়োজন মনে করেননি। সম্পূর্ণ নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন তিনি। সে অনুযায়ী তিনি দামেশকের উপর আক্রমণ চালান। তার জন্য দুর্ভাগ্য ছিলো যে, তিনি সুলতান আইউবীর রণকৌশল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। দুলাখ সৈন্যের উপর ভরসা করে তিনি আরব ভূখণ্ডকে দখল করতে এসেছিলেন। তার দামেশক আক্রমণকে দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ বলা হয়। কিন্তু ফ্রেডারিক এই দুলাখ সৈন্য দ্বারা দামেশকের একটি ইটও খসাতে সক্ষম হননি। মুসলমান গেরিলারা তার রসদের উপর এমন দুঃসাহসী কমান্ডো আক্রমণ চালায় যে, তারা তার হাজার হাজার ঘোড়া ও ঘোড়াগাড়ি নিয়ে আসে। রসদগুলো তাদের বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
ফ্রেডারিক শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। তার রসদের অভাব দেখা দেয়। বিপুলসংখ্যক সৈন্য প্রাণ হারায়। তিনি পেছনে সরে গিয়ে নতুন উদ্যমে দামেশক আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দেন। কিন্তু মুসলিম গেরিলারা তার বাহিনীকে স্থির হয়ে বসতে দেয়নি। পানির উৎসগুলোও মুসলমানরা দখল করে নেয়। ঘটনাটা ১১৯১ সালের ২০ জানুয়ারি মোতাবেক ৫৮৬ হিজরীর ২২ যিলহজ্বের। শোকাহত হয়ে জার্মানিরা তাদের ক্যাম্পে স্থানে স্থানে কাঠ সঞ্চয় করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যেনো ক্যাম্প জ্বলছে। এদিকে মুসলিম সৈন্যরাও নিজ ক্যাম্পে উল্লাসে মেতে ওঠে।
ফ্রেডারিকের এক পুত্র জার্মানি বাহিনীর কমান্ড হাতে তুলে নেয়। তার জানা ছিলো, ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস ও ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ডও আসছেন। তারা রণতরী নিয়ে আসছেন। ফ্রেডারিকের পুত্র বাহিনীকে ফিলিস্তীনের উপকূলীয় নগরী আক্রার দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। সুলতান আইউবী তার সালারদেরকে পূর্বেই দিক-নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন। সে মোতাবেক তারা খৃষ্টান বাহিনীর উপর আক্রমণ না করে যেতে দেয়। সালারদের জানা ছিলো, পথে তাদের কমান্ডো বাহিনী উপস্থিত রয়েছে। তাদের কৌশল ছিলো, তারা শত্রু বাহিনীর একেবারে পেছন অংশের উপর আক্রমণ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো। তারা সংখ্যায় ছিলো অনেক। রাতে জার্মানরা প্যারেড করার সময় কমান্ডোরা ছোট মিনজানিকের সাহায্যে তরল দাহ্য পদার্থ ভর্তি পাতিল এবং পরক্ষণেই জ্বলন্ত সলিতাওয়ালা তীর ছুঁড়ছিলো। তাতে ক্যাম্পে আগুন ধরে যেতো।
জার্মান বাহিনী যখন আক্রা পৌঁছে, তখন তাদের সেনাসংখ্যা কমে বিশ হাজারে নেমে এসেছিলো। অথচ এই বাহিনী যখন পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করে, তখন সংখ্যা ছিলো দুলাখ। তাদের কিছু দামেশক আক্রমণের সময় নিহত হয়েছে। কিছু রোগ ও ক্ষুৎপিপাসায় মারা গেছে। কিছু দামেশক থেকে আক্রা যাওয়ার সময় পথে মুসলিম গেরিলাদের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। সেই সৈনিকদের সংখ্যাও কম ছিলো না, যারা ফৌজ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। শেষমেষ যে বিশ হাজার রক্ষা পেয়েছিলো, তারা সম্পূর্ণরূপে মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলো। তাদের অন্তর থেকে ক্রুশের শ্রদ্ধা ও নিজেদের শপথ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।
ওদিক থেকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সম্রাটদ্বয় নদীপথে এগিয়ে আসছেন। ইংল্যান্ডের ফৌজ- যারা কাবরাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে- কীরূপ এবং সংখ্যা কতো, সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত সময়মতো জেনে ফেলেছেন। তারা ষাট হাজার। ফ্রান্সের বাহিনীর সংখ্যাও প্রায় অনুরূপ। আছে বিশ হাজার জার্মান ফৌজ। খৃস্টানদের আরো কিছু সৈন্য পূর্ব থেকেই পবিত্র ভূমিতে রয়েছে।
সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত সংবাদ পান, যে সম্রাট গাই অফ লুজিনান ভবিষ্যতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, কাউন্ট অফ কনডের সঙ্গে যোগ দিয়ে তিনি বাহিনী গঠন করেছেন, যাতে সাতশ নাইট, নয় হাজার ফিরিঙ্গ সৈন্য এবং বারো হাজার ওলন্দাজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় অফিসার-সৈন্য রয়েছে। এভাবে শুধু তার বাহিনীরই সেনা সংখ্যা প্রায় বাইশ হাজার হয়ে গেছে। আনুমানিক হিসেবে খৃস্টান যৌথ বাহিনীর সেনাসংখ্যা ৬ লাখে দাঁড়িয়েছে, যারা অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামের দিক থেকে। ইসলামী ফৌজ থেকে উন্নত।
সুলতান আইউবীর সঙ্গে দশ হাজার মামলুক ছিলো। এটি তার একটি নির্বাচিত বিশেষ বাহিনী, যাদের উপর তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। আক্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটি বন্দর এলাকাও। প্রাকৃতিকভাবেই অঞ্চলটা এমন যে, নৌবাহিনীর এক বিশাল ও নিরাপদ ক্যাম্পরূপে গড়ে উঠতে পারে। আক্ৰা নগরীতে সুলতান আইউবীর সৈন্যসংখ্যা ছিলো দশ হাজার। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সাহায্য নিতে পারছেন না। কেননা, এটিই সেই ভূখণ্ড, যার জন্য খৃষ্টানদের এই মহা-সমরের আয়োজন-প্রস্তুতি। এর প্রতিরক্ষা এতোটুকুও দুর্বল করা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ডের নৌ-বহর অনেক শক্তিশালী ও ভয়ংকর। সুলতান আইউবী ভালোভাবেই জানেন, তার মিসরী নৌ-বহর ইংল্যান্ডের বহরের মোকাবেলা করতে পারবে না।