আর তাকে বলে দাও, আমি তার সঙ্গে কোনো কথা বলবো না সুলতান আইউবী বললেন- তাকে বলে দাও, আমি জানি সে এই চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে। তাকে আরো বলে দাও, রানী সাবীলার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমি তাকে মুক্তি দেইনি। তাকে জানাতে চাই, আমি তার মতো অপরাধীকে ক্ষমা করতে জানি। আমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছি। কারো নিকট থেকে আমি ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চাই না। আর সে যেখানে যেতে চায়, নিরাপত্তা প্রহরায় পৌঁছিয়ে দাও।
গাই অফ লুজিনান- যিনি বাইতুল মুকাদ্দাসের শাসনকর্তা ছিলেন এবং হিত্তীন যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন- শপথনামায় স্বাক্ষর করে সুলতান আইউবীর সম্মুখে এসে দাঁড়ান। সুলতান তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দেন। গাই আগ্রহের সঙ্গে সুলতানের সঙ্গে হাত মেলান এবং বললেন- আইউবী! তুমি মহান।
গাই অফ লুজিনান মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে সুলতান আইউবীর তাবু থেকে বেরিয়ে যান।
***
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ গাই অফ লুজিনানের মুক্তির ঘটনা উল্লেখ করে একে রানী সাবীলার কৃতিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন। তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী রানী সাবীলার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং গাইকে নিজের মতো একজন রাজা জ্ঞান করে মুক্তি দিয়েছিলেন। তারা এও বুঝনোর কসরত করেছেন যে, সাধারণ ও গরীব লোকদের প্রতি সুলতান আইউবীর কোনো সমবেদনা ছিলো না। অথচ তাদের এই মূল্যায়ন সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় এক গরীব খৃষ্টান মহিলার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন।
গাই অফ লুজিনানের মুক্তির পর যখন খৃষ্টানরা উপকূলীয় নগরী আক্রমণ অবরোধ করে দেখেছিলেন, সে সময়কার ঘটনা। খৃষ্টান বাহিনীর ক্যাম্পের সঙ্গেই সেই খৃষ্টান নাগরিকদের আশ্রয় শিবির ছিলো, যারা বাইতুল মুকাদ্দাস ও অন্যান্য স্থান হতে বেরিয়ে এখানে এসে সমবেত হয়েছিলো। অবরোধের বয়স দুবছর হয়ে গেছে। একদিকে সুলতান আইউবীর গেরিলা সৈনিকরা অবরোধকারী খৃস্টান সৈনিকদের কোনো না কোনো অংশের উপর গেরিলা আক্রমণ চালাচ্ছে, উক্ত অঞ্চলের অসামরিক মুসলমানরাও তাদের নানাভাবে বিরক্ত ও অস্থির করে চলেছে। খৃস্টান নাগরিকরা সৈন্যদের সঙ্গে ছিলো বলে সৈন্যদের অনেক সাহায্য দিচ্ছে।
অসামরিক মুসলমানরা উক্ত অসামরিক খৃস্টানদেরও উত্যক্ত-পেরেশান করতে থাকে। তারা রাতে তাদের ক্যাম্পে ঢুকে যেতো এবং তাদের জিনিসপত্র তুলে নিয়ে আসতো। কখনো কখনো এক-দুজন খৃস্টানকেও তুলে নিয়ে আসতো এবং তাদেরকে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে ঢুকিয়ে দিতো। সাধারণ খৃস্টানরা নিজ বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানাতে থাকে যে, মুসলমান চোর-ডাকাতরা রাতে তাদের মালপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বাহিনী পাহারার ব্যবস্থা করে। তথাপি এই চুরি ও অপহরণের ধারা অব্যাহত থাকে।
এক রাতে এক ব্যক্তি খৃস্টানদের ক্যাম্প থেকে তিন মাস বয়সের একটি শিশুকন্যাকে তুলে নিয়ে আসে। মায়ের একমাত্র কন্যা এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু। মহিলা হাউমাউ শুরু করে দেয়। খৃস্টান কমান্ডারদের নিকট যায়। সে পাগলের মতো হয়ে গেছে। খৃস্টানদের সেনাপতি পর্যন্ত গিয়ে অভিযোগ দায়ের করে। সেনাপতি তাকে পরামর্শ দেয়, সুলতান আইউবীর ক্যাম্প কাছেই আছে; তুমি গিয়ে বিষয়টা তাকে জানাও। সকলের দৃঢ় বিশ্বাস, শিশুটিকে কোনো মুসলমানই তুলে নিয়ে গেছে।
পাগলপারা মা জিজ্ঞেস করে করে সুলতান আইউবীর ক্যাম্পে এসে হাজির হয়। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, তিনি তখন সুলতান আইউবীর পার্শ্বে দাঁড়ানো ছিলেন এবং সুলতান কোথাও যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় চড়ে বসেছেন। এক ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে, এক গরীব খৃস্টান মহিলা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। সে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে। সুলতান আইউবী বললেন, তাকে এক্ষুনি নিয়ে আসো। নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষ থেকে তার উপর বাড়াবাড়ি হয়ে থাকবে।
মহিলা সুলতান আইউবীর সামনে এসে ঘোড়ার সন্নিকটে ধপাস করে বসে পড়ে এবং মাটিতে মাথা ঠুকে ঠুকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সুলতান বললেন, ওঠে বলো তোমার উপর কে জুলুম করেছে?
আমাদের বাহিনীর সেনাপতি বললেন, তুমি সুলতান আইউবীর নিকট চলে যাও, তিনি খুব দয়ালু মানুষ। তিনি তোমার ফরিয়াদ শুনবেন- মহিলা বললো- আপনার লোকেরা আমার একমাত্র দুগ্ধপোষ্য শিশু কন্যাটিকে তুলে এনেছে।
কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, মহিলার ফরিয়াদ-ক্রন্দনে সুলতান আইউবীর চোখে অশ্রু নেমে আসে। শিশুটি অপহৃতা হয়েছে সাত দিন হয়ে গেছে। সুলতান আইউবী ঘোড়র পিঠ থেকে নেমে আসেন। তিনি আদেশ করেন, এক্ষুনি খোঁজ নাও, শিশুটিকে কে এনেছে। তিনি মহিলাকে আহার করাতে বললেন এবং যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো পরিকল্পনা মুলতবি করে দেন।
যেসব সাধারণ মুসলমান খৃস্টান ক্যাম্প থেকে মালপত্র নিয়ে আসতো, তারা বাহিনীর সঙ্গেই থাকতো। তাদের যে লোকটি শিশুটিকে তুলে এনেছে, সে ক্যাম্পেই অবস্থান করছে। সংবাদ শুনে সে সুলতান আইউবীর নিকট ছুটে গিয়ে বললো, মহামান্য সুলতান! শিশুটিকে আমি এনেছি এবং বিক্রি করে ফেলেছি। সুলতান আইউবী আদেশ করেন, যাও, মূল্য ফেরত দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসো।
সুলতান আইউবী শিশুটির এসে না পৌঁছা পর্যন্ত নিজ তাঁবুতে অবস্থান করেন। শিশুটি বেশি দূরে যায়নি। ফলে পেতে তেমন সময় লাগেনি। তার মূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে। সুলতান নিজ হাতে শিশুটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে কলিজার টুকরোটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে এবং এমন আবেগের সাথে আদর করে যে, (শাদ্দাদের ভাষায়) আমাদের সকলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সুলতান আইউবী মহিলাকে একটি ঘোড়ায় চড়িয়ে বিদায় করে দেন।– বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর মুসলমানদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং ফিলিস্তীনের প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে খৃস্টানরা উৎখাত হয়ে গেছে। খৃস্টান জগতে কম্পন ও হতাশা নেমে এসেছে। সে যুগে সামরিক দিক থেকে তিনটি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী জ্ঞান করা হতো- ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ড। তাদের পোপ স্বয়ং প্রতিটি দেশের সম্রাটদের নিকট গিয়ে গিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে তার বক্তব্য ছিলো নিম্নরূপ–