আমার আসল শক্তি হচ্ছে, আমি যখন পরাজিত হই, তখন তার দায়ভার নিজের মাথায় তুলে নেই। তখন জাতি পরাজয়কে জয়ে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়ে যায়। পরাজয়ের দায়ভার যদি একজন অপরজনের উপর চাপাতে চেষ্টা করে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে থাকে, তাহলে এক পরাজয়ের পর আরেক পরাজয় সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আমি যদি তা-ই করতাম, তাহলে দ্বিধাবিভক্ত সালতানাতে ইসলামিয়া বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়তো। মুহতারামা! আমাদের গৃহযুদ্ধের জন্য দায়ী আস-সালিহ ছিলো কিংবা সাইফুদ্দীন, আপনি ছিলেন অথবা গোমস্তগীন। কিন্তু আমি আমার সালারদের বলে দিয়েছি, এ দায়-দায়িত্বও আমার। তার মোকাবেলায় আমি প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহার করেছি এবং আল্লাহর সৈনিকগণ রক্তের বিনিময়ে খণ্ডিত সাম্রাজ্যকে এক সুতোয় গেঁথে নিয়েছি। রক্তের আঁঠায় জোড়া লাগানো খণ্ড পরে কোনোদিন আলগা হয় না রানী সাবীলা! আপনি স্মরণ করুন, আপনাদের বাহিনী মদীনা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। অথচ আজ আপনি আমার নিকট আপনার একজন সম্রাটের মুক্তি ভিক্ষা চাচ্ছেন। এ কোন্ কাজের ফল? সে কাজটি হচ্ছে, মহান আল্লাহ আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমি জীবনের বাজি লাগিয়ে সে কর্তব্য পালন করেছি। আল্লাহ আমাকে তার জন্য পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।
রানী সাবীলা মনোযোগ সহকারে সুলতান আইউবীর বক্তব্য শুনছিলেন। কিন্তু যৌবনদীপ্ত চিন্তাকর্ষক রূপসী নারী সাবীলার রাঙা ঠোঁটে অবজ্ঞার মুচকি হাসি, যে হাসির মর্ম সুলতান আইউবী ভালোভাবেই বোঝেন।–
আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি না- সুলতান আইউবী বললেন- আপনার মুখের হাসি বলছে, এই তাবু থেকে বের না হয়েই আপনি আমার কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলবেন, যেভাবে হিত্তীন ও বাইতুল মুকাদ্দাসে আপনাদের বাহিনী অস্ত্র ত্যাগ করেছিলো। কথাগুলো আমি আপনাকে এ জন্য বলছি যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ আছে, যাদের চোখে আবরণ পড়ে গেছে, তাদের আবরণ খুলে দাও এবং তাদের হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝিয়ে দাও। ভেবে দেখুন সম্মানিতা রানী? আপনার স্বামী আমাকে হত্যা করার লক্ষ্যে চারবার সংহারী আক্ৰমণ করিয়েছিলো। একবার আমি গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিলাম। সে অবস্থায় তারা আমার উপর হামলা চালিয়েছিলো। কিন্তু হলো কী? তারা নিজেরাই খুন হলো। একবার আমি একাকি তাদের ঘেরাওয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি রক্ষা পেয়ে গেলাম আর তারা মারা গেলো। আপনার সেই স্বামী নিজেই শেষ পর্যন্ত সেই ফেদায়ীদের হাতে খুন হলো। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারলো না। বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন।
মন দিয়ে শুনুন রানী! হিত্তীনের রণাঙ্গন থেকে আপনার স্বামী যুদ্ধ না করে পালিয়ে গিয়েছিলো। আপনিও বিনাযুদ্ধে তাবরিয়ার দুর্গ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আপনারা সকলে যে বড় কুশটির উপর হাত রেখে যুদ্ধ করার ও জীবন দেয়ার শপথ করেছিলেন, সেটি সেই রণাঙ্গনেই আপনাদের সেই পাদ্রীর রক্তে ডুবে গিয়েছিলো, যাকে আপনারা ক্রুশের প্রধান মোহাফেজ বলে থাকেন। সেই কুশ এখন আমার দখলে। আর আপনি আমার নিকট গাই অফ লুজিনানের মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছেন।
এ বিষয়গুলো আপনি আমাকে স্মরণ করাচ্ছেন কেননা রানী সাবীলা ঝাঝালো কণ্ঠে বললেন।
যাতে আপনি মহান আল্লাহর এই ইঙ্গিতগুলো বুঝতে পারেন-সুলতান আইউবী উত্তর দেন- আপনার চোখের উপর রাজত্বের পট্টি বাধা আছে। রাজত্ব ও ক্ষমতা আপনার জন্য বিরাট এক গৌরবের বিষয়। তাছাড়া আশা করি, আপনি এই সত্যটাকেও অস্বীকার করবেন না যে, একজন রূপসী নারী হওয়ার জন্য আপনি গর্বিত। আমি একথা বলে আপনাকে খুশি করতে পারি যে, বাস্তবিকই আপনি সুন্দরী। তবে এ কথা বলে নিরাশও করবো যে, আপনার রূপে প্রভাবিত হয়ে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। আপনার অর্ধনগ্ন দেহ আমাকে সরল-সঠিক পথ থেকে সরাতে পারবে না।
রানী সাবীলা একজন সাধারণ মহিলার ন্যায় হেসে ওঠেন এবং বলেন আমাকে বলা হয়েছিলো আপনি পাথর।
সুলতান আইউবী মুচকি হেসে বললেন- আপনার জন্য আমি অবশ্যই পাথর। কিন্তু আসলে আমি এমন এক মোম, যা ঈমানের উত্তাপে গলে যায়– এবং মমতার জযবাও তাকে গলিয়ে দেয়। দৈহিক সুখভোগ ও বিলাসিতা মানুষকে অকর্মণ্য করে তোলে। এমন ব্যক্তি না নিজের কোনো কাজে আসে, না জাতির। খোদার দরবারেও তার কোনো স্থান থাকে না।
আমি আপনার হৃদয়ে মমতার জযবা সৃষ্টি করতেই এসেছিলাম- রানী সাবীলা বললেন- গাইকে মুক্তি দিন। আমি শুনেছি সাচ্চা মুসলমানের ঘরে যদি দুশমন ঢুকে পড়ে, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
এবার রানী সাবীল অনুনয়-বিনয়ের সুরেই কথা বলতে থাকেন। সুলতান আইউবী বললেন, গাইকে এক শর্তে মুক্তি দিতে পারি। সে আমাকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেবে, জীবনে কখনো আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে না।
রানী সাবীলা বললেন, লিখিত শপথনামা দেয়া হবে। এ-ও লেখা হবে, যদি তিনি এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন এবং পরে কখনো গ্রেফতার হোন, তাহলে আপনি তাকে হত্যা করে ফেলবেন।
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়। রানী সাবীলা চলে যান।
ঈমানদীপ্ত আত্মন ০২০৬
সুলতান আইউবী সেদিনই গাই অষ্ণ লুজিনানের মুক্তির আদেশনামা দিয়ে দামেশকে দূত পাঠিয়ে দেন। তিন-চারদিন পর গাইকে সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে আসা হলো। সুলতান বললেন, চুক্তিনামাটি তাকে তার ভাষায় শোনাও। যদি সে প্রয়োজন মনে করে, তাহলে তার ভাষায়ও লিখে স্বাক্ষর নিয়ে নাও।