সালাহুদ্দীন।- রানী সাবীলা বললেন- আপনি নিজে রাজা। নিশ্চয়ই বোঝেন, একজন রাজার কারাগারে পড়ে থাকা তার জন্য কতো বড় অপমান। তিনি তো জেরুজালেম এবং আশপাশের দূর-দূরান্ত অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন।
জেরুজালেম নয়- বায়তুল মুকাদ্দাস- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন- তোমাদের গাই এই ভূ-খণ্ডটির লুটেরা ছিলেন। আমরা কোনো লুটেরাকে ম্রাট বলি না। যদি বলতেন, তিনি ইসলামের মূলোৎপাটন করে এখানে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন, তাহলে আমি আপনাকেও শ্রদ্ধা করতাম এবং তাকেও। আমি সেই লোকদের মন-প্রাণ দিয়ে শ্রদ্ধা করি, যারা আপন ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হোক তার ধর্ম ভিত্তিহীন বা মিথ্যা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি না নিজেকে রাজা মনে করি, না কারো রাজত্ব স্বীকার করি। রাজত্ব শুধুই আল্লাহর। আমরা। তাঁর রাজত্বের পাহারাদার ও সংরক্ষক মাত্র। আমরা আল্লাহর সৈনিক।
আমরাও খোদার রাজ প্রতিষ্ঠার কাজ করছি। রানী সাৰীলা বললেন।– আমি যে খোদায় বিশ্বাসী, আপনিও যদি সেই একই খোদায় বিশ্বাসী হতেন, তাহলে রাজার নয়- রাজার সাধারণ সৈনিকদের মুক্তির আবেদন নিয়ে আসতেন- সুলতান আইউবী বললেন- আপনার অস্বীকার না করা উচিত, এই ভূখও আমাদের আপনাদের নয়। খৃষ্টানরা এখানে শান্তিপ্রিয় নাগরিকের ন্যায় থাকতে পারে- রাজী হয়ে নয়। আপনার দৃষ্টান বন্ধুদের বলে দিন, তারা মানুষের খুন ও লুটপাট থেকে ফিরে আসুক এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাক। আপনাদের প্রতিটি অস্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। আপনারা আপন নিষ্পাপ মেয়েদেরকে পাপের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন এবং তাদের সম্ভ্রম বিকিয়ে দিয়েছেন। আপনারা আমাদের ধর্মনেতাদের ছদ্মবেশে নাশকতাকারী সন্ত্রাসী প্রেরণ করে আমার জাতির বিশ্বাস ও চিন্তা চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। আপনারা হীরা-জহরত, মদ ও রূপসী মেয়েদের দ্বারা আমার জাতির মাঝে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ বপন করেছেন এবং গৃহযুদ্ধ করিয়েছেন। আপনার হাশিশিদের দ্বারা আমাকে হত্যা করাবার একাধিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। হ্যাঁ, ক্রুশের রানী। একটি কাজে আপনারা সফল হয়েছেন যে, আপনারা ইসলামী সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছেন এবং মুসলমানদের দ্বারা মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছেন।
আমার প্রিয় সুলতানা রানী সাবীলা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মানসে বললেন- আমি এতো দীর্ঘ ও জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। আপনি গাই অফ লুজিনানকে মুক্তি দিন।
আমি জানি, এরপর আপনি আর আমার কাছে আসবেন না সুলতান আইউবী বললেন- কেবল আমার এই তাবুতেই নয়- এরপর আপনাকে কোনোদিন এই ভূখণ্ডের কোথাও দেখা যাবে না। আমি আপনাকে আলোচনায় জড়িয়ে রাখতে চাই না। আপনাকে আমি একটি বার্তা দিচ্ছি। এই বার্তাটি আপনি আপনার ক্রুশের সকল পূজারীর কানে পৌঁছিয়ে দেবেন।…
কোথায় আপনাদের সেই বড় কুশ, যার উপর হাত রেখে আপনারা শপথ নিয়েছিলেন যে, আরব ভূমিকে পদানত করবেন, মসজিদে আকসা ও খানায়ে কাবাকে নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের উপাসনালয় বানাবেন সেই কুশ আমার কজায়। আর আপনাদের সেই প্রত্যয় এখন আমার অনুগ্রহ অনুকম্পার প্রত্যাশী। যে ভূখণ্ডটিকে আপনারা জেরুজালেম বলেন, সেটি এখন বাইতুল মুকাদ্দাস এবং চিরদিন বাইতুল মুকাদ্দাসই থাকবে।
আপনার বাহিনী উন্নত এবং সংখ্যায় বেশি রানী সাবীলা বললেন আমাদের বাহিনীর নেতৃত্ব ত্রুটিপূর্ণ।
বাস্তবকে লুকাবার চেষ্টা করবেন না রানী সাবীলা। সুলতান আইউবী বললেন নিজেকে ধোঁকা দেবেন না। আত্মপ্রতারণা পরাজয়ের লক্ষণ। আমার সেনাসংখ্যা কোনদিন খৃষ্টান বাহিনীর চেয়ে বেশি ছিলো না। উন্নতও নয়। আমার ফৌজের কপালে কখনো বর্ম জোটেনি। আপনাদের ঈমানদীপ্ত দান সালারদের তাঁবুতে যেরূপ রূপসী নারীরা শোভা পায়, আমার সালাররা সেরূপ নারী কখনো পায়নি। আমার সৈন্যদের অস্ত্র আপনাদের চেয়ে উন্নত নয়। তবে আমি আপনাকে আমাদের গোপন কথাটা বলে দিচ্ছি, আমার বাহিনীর কাছে একটি শক্তি আছে, আপনাদের বাহিনীর যার থেকে বঞ্চিত। আমরা তাকে ঈমান ও নবীপ্রেম বলি। আপনাদের বিশ্বাস যদি সঠিক হতো,তাহলে খোদা আপনাদের জাতির প্রিয়ভাজন হতেন। কিন্তু তারা তো অদ্বিতীয় এক খোদাকে এক পুত্রের জনক বানিয়ে রেখেছে। আপনারা খোদাকে মানুষের কাতারে নামিয়ে এনেছেন এবং তাঁর রাজত্বের কাছে নতি স্বীকারের পরিবর্তে নিজেদেরকে রাজার আসনে বসিয়েছেন।
আপনি কি আমাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিচ্ছেন? রানী সাবীলা জিজ্ঞেস করেন।
রানী সাবীলা!- সুলতান আইউবী রানী সাবীলার কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। আঁচ করে বললেন- আমার আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, আমি তাদেরকে বিবেক দিয়েছি, কিন্তু তারা চিন্তা করে না। আমি তাদেরকে চোখ দিয়েছি; কিন্তু তারা দেখে না। আমি তাদের কান দিয়েছি; কিন্তু তারা শোনে না। মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, আমি যখন তাদের জন্য শাস্তি অবধারিত করি, তখন তাদের মন-মস্তিষ্কের উপর মোহর এঁটে দেই। আপনি ইসলাম গ্রহণ না করুন। কিন্তু মনে রাখবেন, বিজয় সে-ই লাভ করে, যার অন্তরে ঈমান থাকে। আমার জাতির কর্ণধারদের হৃদয় থেকে যখন আপনারা সম্পদ, নারী ও মদের মাধ্যমে ঈমান বের করে দিয়েছিলেন, তখন আমরা আপসে যুদ্ধ ও রক্তারক্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ আমাদের শান্তিদান করেছেন। সমগ্র জাতি পাপে লিপ্ত হয় না। পাপ করে কর্ণধাররা। কিন্তু শাস্তি ভোগ করে দেশের প্রতিজন নিরীহ মানুষ। জাতি পাপ করে না তাদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়।