হেডকোয়ার্টার থেকে যতোই দূরে থাকুক না কেন, সুলতান আইউবী তাঁর প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছেন এবং তাদেরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাউকে কিছু করতে দিচ্ছেন না। গেরিলা বাহিনী শকুন ও ব্যাঘ্রের ন্যায় পাহাড়-পর্বত ও বন-বিয়াবানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানেই খৃস্টান বাহিনীর কোনো ইউনিট কিংবা রসদের বহর চোখে পড়ছে, অমনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কমান্ডো আক্রমণ করছে, হতাহত করছে ও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাদের ঘোড়া, অস্ত্র ও রসদ সরঞ্জামাদি তুলে আনছে।
এই গেরিলারা যেসব কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করেছে, ইসলামের ইতিহাসে সে এক বিস্ময়কর, ঈমানদীপ্ত ও অস্বাভাবিক বীরত্বের কাহিনী। তার প্রতিটি কাহিনী লিখতে গেলে এই সিরিজ শেষ হবে না। তারা ছিলো ফিলিস্তীনের মাটির প্রহরী। তারা একজন একজন দুজন দুজন ও চারজন চারজনের দলে বিভক্ত হয়ে শত শতজনের শত্রুসেনা দল ও ক্যাম্পের উপর আক্রমণ চালিয়ে রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যেতো কিংবা নিজেদেরই রক্তে ডুবে যেতো। নিজেদের লাগানো আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হতো। শহীদ হওয়ার পর তাদের কপালে কাফন জোটেনি। কেউ তাদের জানাযা পড়েনি। কাউকে সসম্মানে কবরস্ত করা হয়নি।
তারা শত্রুর উপর গজবরূপে আবির্ভূত হতো। তাদেরই উপর নির্ভর করে বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর সুলতান আইউবী সমগ্র ফিলিস্তীনে সিংহের ন্যায় হুংকার দিয়ে চলছিলেন। সুলতান আইউবীর এই গেরিলা ও কমান্ডো বাহিনীগুলো সম্পর্কে প্রখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোল লিখেছেন–
এই বিধর্মীরা (মুসলমানরা) আমাদের নাইটদের ন্যায় ভারি বর্ম পরিধান করতো না। অথচ তারা আমাদের বর্মপরিহিত নাইটদেরকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে দিতো। তাদের উপর আক্রমণ হলে তারা পালাতো না। তাদের ঘোড়াগুলো সমগ্র পৃথিবীতে সবচে দ্রুতগামী ঘোড়া বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তারা যখন দেখতে, খৃস্টানরা তাদের। পেছন থেকে সরে গেছে, তখন তারা পুনরায় ফিরে আসতো। এরা ছিলো সেই ক্লান্তিহীন মাছির ন্যায়, যাদেকে উড়িয়ে দিলে মুহূর্তের জন্য উড়ে আবার ফিরে এসে গায়ে বসে। সারাক্ষণ দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সরে থাকে। যখনই এই প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয়া হয়, অমনি কমান্ডো হামলা করে বসে। তারা পার্বত্য অঞ্চলের ঝড়-বৃষ্টির ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে এসে খৃস্টান বাহিনীর বিন্যাস চুরমার করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতো। তারা আমাদের নাইটদেরকে পায়ে পায়ে অস্থির এবং বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করে রাখতে।
***
বর্তমানে যে ভূখণ্ডটিকে ইসরাইল বলা হয়, এটিই সেই পবিত্র ভূমি, যাকে খৃষ্টানদের থেকে মুক্ত করার জন্য সুলতান আইউবীর আমলে আল্লাহর এক একজন সৈনিক সেখানে নিজ দেহের রক্তের নজরানা দিয়েছিলো। সুলতান আইউবী কয়েকটি বসতিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। মাঝে-মধ্যে মনে হতো তার হৃদয়ে একবিন্দু মমতা নেই। কিন্তু তিনি মমতার এমন এক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন যে, খৃষ্টান ঐতিহাসিকরাও তার প্রশংসা করেছেন। তার নিকট দয়া ভিক্ষার জন্য খৃস্টানদের এক রানীও এসেছিলেন। এসেছিলো এক অসহায় গরীব খৃস্টান মহিলাও।
খৃস্টান রানীর নাম ছিলো সাবীলা। মহিলা প্রখ্যাত খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডের স্ত্রী ছিলেন। হিত্তীন যুদ্ধের সময় তিনি তাবরিয়ার দুর্গের রানী ছিলেন। রেমন্ড হিত্তীনের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তাবরিয়ার দুর্গ সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সুলতান আইউবী তাকে বন্দি করেননি। সেই যুদ্ধে বাইতুল মুকাদ্দাসের ম্রাট গাই অফ লুজিনান সুলতান আইউবীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন।
বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর সুলতান আইউবী আক্ৰায় ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করছেন। তার নিকট সংবাদ আসে, রানী সাবীলা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন। সুলতান তাকে বারণ করেননি। বরং এগিয়ে গিয়ে রানীকে স্বাগত জানান।
সালাহুদ্দীন!- রানী সাবীলা বললেন- আপনি কি জানেন, কতো হাজার নাকি কতো লাখ খৃস্টান গৃহহীন হয়ে পড়েছে? তাদের উপর এই
অবিচার আপনার নির্দেশে হয়েছে।– আর আপনারা যে নিরপরাধ মুসলমানদের গণহত্যা করিয়েছেন এবং করিয়ে যাচ্ছেন, সেটা কার আদেশে হয়েছিলো?- সুলতান আইউবী তার উত্তরের অপেক্ষা না করে বললেন- আমি যদি রক্তের বদলা রক্ত দ্বারা গ্রহণ করি, তাহলে একজন খৃস্টানও রক্ষা পাবে না। তা আপনি কেন এসেছেন? আমার নিকট এই অভিযোগ দায়ের করতে?
না- রানী সাবীলা উত্তর দেন- আমি একটি আবেদন নিয়ে এসেছি। গাই অফ লুজিনান আপনার হাতে যুদ্ধবন্দি হয়ে আছেন। আমি তাকে মুক্ত করতে এসেছি।
আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করবে না, তাকে কেনো মুক্ত করতে চাচ্ছেন- সুলতান আইউবী বললেন- তবে জানতে চাই, তাকে কোন শর্তে মুক্তি দেবো
আপনার পুত্র কিংবা ভাই যদি শক্রর হাতে বন্দি হয়, তাহলে কি আপনি তাকে মুক্ত করার চেষ্টা করবেন না রানী সাবীলা পাল্টা প্রশ্ন করেন।
আপনাদের নিকট আমার যতো কমান্ডার ও সৈনিক বন্দি আছে, তারা সকলে আমার পুত্র-ভাই- সুলতান আইউবী বললেন- যদি স্বয়ং আমিও বন্দি হয়ে যাই, তবু আপনার নিকট আমি মুক্তি ভিক্ষা চাইবো না। আমার কোনো পুত্র কিংবা ভাই আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আপনার নিকট যাবে না।