***
আজ সেই রাত। ছয়টি জাহাজ পাল খুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজগুলোর ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য অফিসার- আল-ফারেসের জাহাজে এসে সমবেত হয়েছে। উন্নতমানের সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত হচ্ছে। মান্না ও সৈনিকগণ নিজ নিজ জাহাজে উৎসব করছে। আল-ফারেসের জাহাজে মেয়ে দুটো নাচছে। দফ ও সারেন্দার বাজনা চলছে। জাহাজে অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। রাতকে দিনে পরিণত করা হয়েছে।
উৎসব যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন রাত অনেক কেটে গেছে। খৃস্টানদের দশ-বারোটি রণতরী আল-ফারেসের জাহাজের দিকে বাতি নিভিয়ে এগিয়ে আসছে। নবচন্দ্রের বিন্যাসে আসছে জাহাজগুলো। নিকটে এসে পৌঁছার পরও কারো খবর হয়নি, শত্রুর নৌবহর আসছে। এদিকে ছোট একটি ডিঙি নৌকা আল-ফারেসের জাহাজের দিকে এগিয়ে আসে। হঠাৎ আল-ফারেসের জাহাজগুলোর উপর জ্বলন্ত গোলা এসে পড়তে শুরু করে এবং এমন মুষলধারায় তীর আসতে শুরু করে যে, মুহূর্ত মধ্যে কয়েকজন মাল্লা ও সৈনিক লুটিয়ে পড়ে। আল-ফারেস ও তার কাপ্তানগণ এই অতর্কিত আক্রমণ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু জাহাজ বের করে নেয়া সম্ভব হলো না। সৈনিকরা তীর ছুঁড়ে আক্রমণের উত্তর দেয়। মিনজানিক দ্বারা গোলা নিক্ষেপ করা হয়। একটি খৃস্টান জাহাজে আগুন ধরে যায়। কিন্তু খৃষ্টানরা তাদের কার্যসিদ্ধি করে ফেলে। তাদের জাহাজ, ফিরে চলে যায়।
যুদ্ধ যেরূপ হঠাৎ শুরু হয়েছিলো, তেমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের বিবরণ তোমাবেক আল-ফারেসের পাঁচটি জাহাজ। পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এ ঘটনা ৫৮৩ হিজরীর ২৭ শাওয়াল মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঘটে।
জাহাজগুলো জ্বলছিলো। প্রজ্বলমান জাহাজের আলোতে এক ব্যক্তি দেখে একটি ডিঙি চলে যাচ্ছে, যাতে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। আল-ফারেস জাহাজ দেখে নৌকা নামিয়ে দিয়ে ধাওয়া করে তাদের ধরার চেষ্টা করেন। এদিক থেকেও তীর ছোঁড়া হয়। ডিঙিটি ঘিরে ফেলা হয়। পুরুষ দুজন ও এক নারী তীরবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। এক মেয়ে রক্ষা পেয়েছে। পরে তার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।
সে সময় সুলতান আইউবী টায়ের থেকে সামান্য দূরে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তার সোজা টায়ের আক্রমণ করার পরিকল্পনা। রওনার একদিন আগে তিনি সংবাদ পান, ছয় জাহাজের পাঁচটি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। এ মুহূর্তে এরূপ দুঃসংবাদ শুনতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অগ্রযাত্রা মুলতবি করে দেন এবং আল-ফারেন্স ও জাহাজের কাপ্তানদের ডেকে পাঠান। আল ফারেস সোজাসাপ্টা উত্তর দেন, সৈনিকদের বিনোদনের জন্য আমরা একটু উৎসবের আয়োজন করেছিলাম। সবাই আনন্দে মেতে ছিলো। সে ফাঁকে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে।
সুলতান আইউবী তার সালার ও উপদেষ্টাদের বৈঠক ডাকেন। সকলকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। সবাই পরামর্শ দেয়, প্রচণ্ড শীত পড়ছে। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। এ মওসুমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া অবিরাম যুদ্ধে সৈনিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো অবিচার হবে। পরিণামে পরাজয় আসতে পারে। তারা নৌবহরের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সুলতান আইউবীকে বুঝবার চেষ্টা করে, এতো দীর্ঘ সময় সৈনিকদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে দূরে রাখার প্রতিক্রিয়া এমনই হয়ে থাকে। এমন না হয় যেন, বাইতুল মুকাদ্দাসের মহান বিজয়ও আমাদের জন্য নতুন কোনো দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুলতান আইউবী একনায়ক শাসক নন। তিনি নায়েব-উপদেষ্টাদের পরামর্শ গ্রহণ করে নেন এবং আদেশ জারি করেন, বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে যে অস্থায়ী বাহিনী গঠন করা হয়েছিলো, সেগুলো ভেঙে দেয়া হোক এবং কিছু অর্থ প্রদান করে তাদের বাড়ি-ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হোক। তিনি তার নিয়মতান্ত্রিক সৈন্যদের একাংশকেও অল্প কদিনের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন এবং নিজে ১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি আক্রার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। মার্চ পর্যন্ত সুলতান আইউবী আক্ৰায় অবস্থান করেন।
৮.৬ রানী সাবীলা
রানী সাবীলা
ক্রুসেড যুদ্ধ তুলে পৌঁছে গিয়েছিলো। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাইতুল মুকাদ্দাস জয় সমগ্র ইউরোপকে তীব্র এক ভূ-কম্পনের ন্যায় কাঁপিয়ে তোলে। সুলতান আইউবী জীবনের মিশন বাস্তবায়িত করে ফেলেছেন। বাইতুল মুকাদ্দাস জয় ছিলো তার জীবনের পরম লক্ষ্য। তবে বাইতুল মুকাদ্দাসকে ক্রুসেডারদের দখল থেকে মুক্ত করাই যথেষ্ট ছিলো না। এই পবিত্র নগরীটির প্রতিরক্ষা মৃদুঢ় করাও আবশ্যক ছিলো। তার জন্য নগরীর চারদিকে শক্ত প্রাচীর নির্মাণের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত আশপাশের অঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকাগুলো দখলে আনাও জরুরি। ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করে ফেলেছেন। অবশিষ্টগুলোর উপর সুলতানের বাহিনী আক্রমণ করছে আর দখল করে নিচ্ছে।
বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে খৃষ্টান নাগরিকরা পালিয়ে যাচ্ছে। যেসব অঞ্চলের উপর খৃস্টানদের দখল ছিলো, সেখানে তারা মুসলমানদের বেঁচে থাকাকে হারাম করে রেখেছিলেন। তাদের জন্য মুসলমানদের গণহত্যা দৈনন্দিন কর্মসূচি ও ধর্মীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার বিপরীতে সুলতান আইউবী যখন যে অঞ্চল জয় করতেন, সেখানকার খৃস্টান অধিবাসীদেরকে নিজ বাহিনীর নিরাপত্তায় বের করে দিতেন, যাতে বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এখন ফিলিস্তীনেও তিনি একই নীতি অবলম্বন করেন। একজন খৃষ্টান নাগরিকও যাতে নিগ্রহের শিকার না হয়, সুলতান আইউবী তার নিশ্চয়তা বিধান করেন।